সংক্রান্তির পুণ্যস্নান শেষ হওয়ার পর ফি-বছরই প্রশাসক আর স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ বাড়ে। সাগরের আশপাশ পরিষ্কার করে তাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ। ফিরিয়ে দেওয়ার মতো অবশ্য আরও কিছু পড়ে থাকে সাগরতটে। কিছু বয়স্ক, অশক্ত মানুষ। অনেকটা আবর্জনার মতোই যাঁদের সম্পূর্ণ অচেনা এক পরিবেশে জমা করে দিয়ে যায় বাড়ির লোক, সন্তানরা। কেউ শুধু নিজের রাজ্যটুকুর নাম জানেন, কেউ আবার নিজের নামও স্পষ্ট বলতে পারেন না। চেষ্টা চলে ওই ভাঙা বুলি আর পুলিশের সাহায্য নিয়ে তাঁদের আসল ঠিকানা খুঁজে বের করার।
এইটুকু পড়ে যদি মনে হয়, এ সব হালের মানসিকতা, তা হলে সেটা দায়সারা ভাবনা। আগেকার কালে কাশী, বৃন্দাবনে এসে ‘হারিয়ে যাওয়া’ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সংখ্যাও কম ছিল না। দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে তখনকার প্রজন্মও একই পথ নিতেন। গঙ্গার ধারে, শিব-কৃষ্ণের দুয়ারে নিজের ঘরের ‘বোঝা’টিকে নামিয়ে আসতে পারলেই অনেক বেমক্কা দায়, খরচ, অশান্তির হাত থেকে মুক্তি। পুণ্যভূমিতে পা দিয়ে নিজের পুণ্যটুকু আবার উপরি পাওনা। আর জানা কথাই যে, বয়স্ক মানুষদের হর্ষবর্ধনের সেই বেড়ালের মতো কোনও আশ্চর্য ক্ষমতা নেই যে, বেড়াল পার করতে এসে পথ হারিয়ে ফেলা দুই ভাইকে নিজেই রাস্তা চিনিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেবে। সুতরাং...
তবে অনেকে কিনা আরও শর্টকাটে বিশ্বাসী। অন্য জায়গায় পৌঁছনোর মতো এত খরচাপাতি না করে অসুস্থ মা-টিকে টুক করে ছাদের ওপর থেকে ফেলে দেন। কেউ আবার শীতের দিনে গাছতলায় বসিয়ে দিয়ে আসেন। কিছু বয়স্ক মানুষ আবার টেনিস বলের মতো বিভিন্ন সন্তানের বাড়িতে ঠোক্কর খেয়ে ফেরেন। তখন আমরা স্কুলে পড়ি। বাংলা সিরিয়ালে ‘জননী’ রমরম করে চলছে। দেখতাম, আশপাশের সব চেনা-অল্প চেনা ঠাকুরমা-দিদিমা ভয়ংকর মন দিয়ে তার প্রতিটি এপিসোড দেখতেন। কখনও চোখের জল মুছতেন, কখনও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন। আসলে, তাঁরা তো শুধু সিরিয়ালে মজে থাকতেন না। নিজের ভবিষ্যৎটাও আঁচ করতে চাইতেন। হয়তো সিরিয়ালি সংলাপ শুনে মনের মধ্যে গুছিয়ে নিতেন নিজের বক্তব্যগুলোও।
সিরিয়ালের ‘জননী’ সব বাড়িতেই ভালবাসা জিতে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবের জনকজননীরা অনেকেই সেই খেলায় হেরে ভূত হয়ে যান। কারণ আগাগোড়াই তাঁরা এক বিপজ্জনক বিশ্বাস নিয়ে দিন কাটান— শেষ বয়সে সন্তানই দেখভালের সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে। তাই জীবনের সমস্ত সঞ্চয়টুকু ছেলেমেয়ের পড়ার পিছনে বেরিয়ে যাক, মাথার ওপরের ছাদটুকু ছেলে নিজের নামে লিখিয়ে নিক, মেয়ে নিয়ে যাক গয়নার বাক্স। আহা, তার বিনিময়ে তো ওরা থাকতে দেবে, চার বেলা খাবার দেবে, অসুখে ওষুধটুকু দেবে। কিন্তু এর বদলে যখন জোটে কোনও এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দেওয়া খিচুড়ি, কিংবা কংক্রিটের রাস্তায় কম্বল, তখন স্বপ্ন ভেঙে চুরচুর। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। চলচ্চিত্রের বৈভবটুকু বাদ দিলে ‘বাগবান’-এর সমস্ত চরিত্র ও সংলাপগুলো বড় বেশি বাস্তব।
২০১৬ সালে দিল্লি হাই কোর্ট রায় দিয়েছিল, পৈতৃক বাড়ির ওপর ছেলের কোনও অধিকার থাকবে না। সে ততক্ষণই সেই বাড়িতে থাকতে পারবে, যতক্ষণ বাবা-মা তাকে থাকতে দেবেন। রায় দেওয়া হয়েছিল সেই সব মানুষের কথা ভেবে, যাঁরা নিজের বাড়ি থাকতেও সন্তানের অত্যাচারে বাড়িছাড়া। তার পর সচেতনতা হয়তো কিছু বেড়েছে। কিন্তু জোর করে বাড়ি লিখিয়ে নেওয়ার প্রবণতায় ছেদ পড়েনি। কখনও মারধর, কখনও পরে না-দেখার হুমকির মুখে পড়ে তাঁরাই বাধ্য হয়ে নিজের সম্পত্তি ছেলে বা মেয়ের নামে করে দিচ্ছেন। একাধিক সন্তান হলে সমস্যা আরও বেশি। যে সন্তান বকলমে বাবা-মায়ের দেখাশোনা করে আসছেন, তিনিই সমস্ত সম্পত্তি দখল করতে চান, দেখাশোনার ফি-বাবদ। সম্পত্তি এক বার নিজের মুঠোয় এলে তাঁদের অনেকেই বয়স্ক মানুষগুলোকে ঠেলে দেন অন্য ভাই-বোনদের দিকে। তখন সম্পত্তি না-পাওয়ারাও বেঁকে বসেন। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ঠাঁই হয় কখনও আশ্রমে, কখনও তাঁরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, নয়তো ন্যায়বিচারের আশায় দৌড়ে বেড়ান।
এই অবস্থা থেকে বাঁচতে অনেক আগে থেকেই কিছু কঠিন, কিন্তু যুক্তিসম্মত রাস্তা ভেবে রাখা উচিত। সন্তানই ভবিষ্যতের অবলম্বন— এই নাটকীয় ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার সময় বোধহয় হয়েছে। বিশেষ করে, যে মহিলারা আয়ের দিক থেকে সম্পূর্ণ স্বামীর উপার্জনের উপর নির্ভরশীল, তাঁদের জেনে রাখা উচিত স্বামীর সঞ্চয়ের হদিশ। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির অর্ধেক যে তাঁরও প্রাপ্য এই সামান্য কথাটুকুই বা ক’জন মহিলা জানেন! এইটুকু জেনে রাখলেও তো পুত্রের সংসারে জড়সড়, কুণ্ঠিত হয়ে থাকার ভাবটা অনেকখানি কমানো যায়। স্বামীর পেনশন তাঁর স্ত্রী-ই পাবেন। সেটা সংসারে খরচ হবে, না নিজস্ব সিন্দুকে ঢুকবে— সেটার নিয়ন্ত্রকও স্ত্রী-ই, সন্তান নয়। অনেক বয়স্ক মা-ই ব্যাংকের হিসেবপত্র না বুঝে নির্দ্বিধায় পেনশন, সুদের টাকা সন্তানের জিম্মায় রাখেন। অথচ, তাঁর চশমার ডাঁটি ভেঙে গেলে, নতুন একটা জোটে না।
তাই অধিকার সংক্রান্ত কিছু আইন আগেই জেনে রাখা ভাল। সঙ্গে সরকারি স্বাস্থ্য যোজনা, বয়স্ক মানুষদের দেখাশোনার জন্য কলকাতা পুলিশের কিছু কর্মসূচি, এই সব নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকাও দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, কর্মজীবনের একটা বড় অংশের সঞ্চয় নিজেদের বার্ধক্যের জন্যই তোলা থাক, সবটুকু চেঁচেপুঁছে সন্তানের ভবিষ্যতের পিছনে লগ্নি না করে। সন্তানস্নেহ ভাল, সন্তানের ওপর বিশ্বাস রাখাও ভাল। কিন্তু অন্ধ-বিশ্বাস ভাল নয়। কোনও ক্ষেত্রেই নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy