ডোনাল্ড ট্রাম্প। —ফাইল চিত্র।
অপ্রত্যাশিত ছিল না। বরং সমস্ত রকম ইঙ্গিত ছিল। তবু ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আমেরিকার সমাজের একাংশে হতাশা ও ভয়ের ঢল নেমে এসেছে। সেটাই হয়তো বলে দেয় বৃহত্তর বাস্তবের সঙ্গে উদারবাদী এবং মধ্যপন্থী আমেরিকান সমাজের, এবং তৎসূত্রে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কতটাই অপরিচয় ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প কেবল জেতেননি, ২০১৬ সালের জয়ের থেকে এ বারের জয় আরও বেশি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন, পপুলার ভোটের শতাংশ তাঁর ঝুলিতে আরও অনেক বেশি। কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের মহিলা পুরুষ দুই অংশের ভোট প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের ভাগে জুটেছে— কিন্তু এ ছাড়া বাকি প্রায় সব রকম জনগোষ্ঠীর ভোটেই ট্রাম্প এগিয়ে, শ্বেতাঙ্গ নারী ও পুরুষ, অভিবাসী, ল্যাটিনো, অশ্বেতাঙ্গ নাগরিকবর্গ। কেন এই রক্ষণশীলতার টগবগে আবেগ, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ? এত দিন ডেমোক্র্যাটরা খুব তলিয়ে ভাবেননি, মাঝখান থেকে তরুণ ভোটারদের এক বড় অংশকে বিমুখ করে দিয়েছেন আগ্রাসী ইজ়রায়েল সমর্থন দিয়ে। সন্দেহ নেই, প্যালেস্টাইন সঙ্কটের প্রভাব এ বারের কমলা হ্যারিস-বিরোধী পালে বিস্তর হাওয়া জুগিয়েছে। উদারবাদ ও সহনশীলতা এতটাই পরিত্যাজ্য হলে জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীলতা ও আক্রমণবাদকে ‘ভুল’ প্রতিষ্ঠা করা কেবল মুশকিল নয়, অসম্ভব। অনেক দিন ভাবের ঘরে চুরি হল। এ বার কি তাঁরা খানিক আত্মসমীক্ষা করার সময় পাবেন যে ঠিক কোন মূল্যবোধে তাঁরা বিশ্বাসী, এবং সেই মূল্যবোধকে কেন তাঁরা এমন ভাবে ঠুনকো সুবিধাবাদে পরিণত করেন?
ত্রিশোর্ধ্ব অপরাধে স্বীকৃত অপরাধী, এবং যৌন নিগ্রহের গোটা-আষ্টেক অভিযোগে দোষী ট্রাম্প দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট পদে এলেন, তার একটি কারণ তিনি ও তাঁর পার্টি কিন্তু বিপরীত দিকের এই দুর্বলতাগুলি চিনতে ভুল করেননি। বুঝেশুনেই তাঁরা নিজেদের অতীতযুগীয় রক্ষণশীলতা, নারীস্বাধীনতা-বিরোধিতা, শিক্ষাসংস্কৃতির অবমাননা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অভিবাসীর প্রতি আক্রমণ, এ সব নিয়ে কিন্তু-কিন্তু না করে জোর গলায় ঘোষণা করেছেন, ট্রাম্প জয় পেলে ধারাগুলি প্রবলতর হবে। বলা যেতে পারে, এক দিকে রিপাবলিকান পক্ষের স্পষ্ট অসহিষ্ণুতা, অন্য দিকে ডেমোক্র্যাট পক্ষের অস্পষ্ট চোরাগোপ্তা অসহিষ্ণুতা: এ বারের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মূল সূত্র এটাই, নির্বাচনী ফলের রহস্যও নিহিত এখানেই। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আজও কোনও মহিলা রাষ্ট্রনেত্রীর জন্য প্রস্তুত নয়, সুতরাং কমলা হ্যারিস এসে স্বপক্ষের জোর বাড়াতে পারেননি।
আমেরিকার বাইরে এই প্রত্যাবর্তনের ফলাফল কেমন দাঁড়াবে? প্যালেস্টাইন আগ্রাসনে কোনও তারতম্য ঘটার কথা নয়, বরং ইজ়রায়েলের কট্টরপন্থী শিবিরের উল্লসিত প্রত্যাশা বাড়ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের বেগ কমতেও পারে, যে-হেতু ট্রাম্প-পুতিন নৈকট্যের অন্তত আংশিক সত্যতা অনস্বীকার্য। পরিবেশ প্রশ্নে আমেরিকা হয়তো আবারও আক্রমণাত্মক অসহযোগে ফিরে যাবে, যেমন করে ২০১৭ সালে প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন গত বারের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ভারতের দিক দিয়ে আশা-হতাশার দোলাচল। এক দিকে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের কিছুটা স্বস্তি। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আমেরিকা বাংলাদেশের বর্তমান শাসনের অতি ঘনিষ্ঠ ছিল, কিন্তু ট্রাম্প ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সংখ্যালঘু-নিপীড়ন এবং নৈরাজ্য নিয়ে বহু কড়া কথা বলে ভারতের পক্ষে জোর জুগিয়েছেন। চিনের সঙ্গেও পূর্বতন ট্রাম্প প্রশাসনের অমিষ্ট সম্পর্কের স্মৃতি ভারতের আশার কারণ। অন্য দিকে, ট্রাম্পের আমলে শুল্কবিধি কঠোরতর হলে বাণিজ্যক্ষেত্রে ভারতের উপর চাপ বাড়বে। সব মিলিয়ে নতুন ভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিন্যাসের জন্য প্রস্তুতি চাই: ট্রাম্পের দ্বিতীয় পর্ব প্রথম পর্বের থেকে কঠিনতর হবে, এই অনুমান ভিত্তিহীন নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy