সরকারি ও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলের বাড়িগুলি রং করাইবার সিদ্ধান্ত লইয়াছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ফ্লাইওভার, রাস্তার রেলিং ও কর-রেহাই-প্রাপ্ত বাড়ির ন্যায় স্কুলগুলির রং হইবে নীল-সাদা, ইহাই সরকারের অভিলাষ। মথুরাপুরের একটি স্কুল সরকারের এই ‘চাপাইয়া দেওয়া’ সিদ্ধান্ত মানিয়া লইতে নারাজ। স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, বরাবর ওই স্কুলবাড়ির রং থাকিয়াছে গৈরিক। সেই ঐতিহ্য ভাঙিবার জন্য জবরদস্তি করিলে তাঁহারা আদালতের দ্বারস্থ হইবেন। এই প্রতিবাদী ক্ষোভ অসংগত নহে। নীল-সাদার প্রতি রাজ্য সরকারের অনুরাগ সুবিদিত, সেই অনুরাগের উৎসও কাহারও অজানা নহে। কিন্তু আপন পছন্দের ভার অপরের উপর চাপাইয়া দেওয়ার বাসনাকে, আর যাহাই হউক, গণতন্ত্রসম্মত বলা চলে না। শিক্ষামন্ত্রী নিশ্চয় সপাটে জবাব দিবেন: স্কুলের জন্য টাকা দিই, আর স্কুলবাড়ির রং বলিয়া দিতে পারিব না? গণতন্ত্রের দেবী স্তম্ভিত হইবেন না, তিনি এই দম্ভে অভ্যস্ত হইয়াছেন।
রাজ্য সরকারের নায়কনায়িকারা হয়তো ফোঁস করিবেন— অন্য রং হইলে তাঁহারা বিবেচনা করিতেন, তাই বলিয়া গৈরিক? যে গৈরিক হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির রং? নিন্দুকরা বঙ্কিম হাসি হাসিয়া বলিতে পারেন, অধুনা তো তাঁহারাও হিন্দুত্বের দিকে অল্পস্বল্প ঝুঁকিতেছেন, হনুমান-পূজাতেও মতি হইয়াছে, মনই যখন রাঙাইয়াছেন, স্কুলবাড়ি রাঙাইতে আপত্তি কেন? নিন্দুকের কথা থাকুক। কিন্তু, ভাবিয়া দেখিলে, গৈরিক রংটির কী মাহাত্ম্য ছিল এবং আজ তাহা কোথায় পৌঁছাইয়াছে! ঐতিহ্যের ব্যাকরণে এই রং ত্যাগের প্রতীক। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরা গৈরিক বস্ত্র পরিধান করিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু সেই ঐতিহ্যকে বিপুলবিক্রমে খর্ব করিয়া গৈরিক হইয়া উঠিয়াছে হিন্দুত্বের রং, এমনকী গৈরিকবসন ‘সাধুসন্ত’রাও অনেকেই এখন গৈরিক পতাকার তলে সমবেত হইয়া রাজনীতি করিতে ব্যগ্র। যাঁহারা এ ঘোর কলিতেও ত্যাগের প্রতীক হিসাবে গেরুয়া পরিধান করিতেছেন, তাঁহারা না চাহিলেও তাঁহাদের ভাবমূর্তি হিন্দুত্বের সহিত জড়াইয়া পড়িতেছে।
জড়াইয়া পড়িতেছে বিবিধ অনুষঙ্গে। পরিব্রাজক গৈরিক বসন পরিয়া ভ্রমণ করিতেন। পরিব্রাজক কথাটির অর্থ: ‘নিত্যভ্রমণকারী ভিক্ষু’। অর্থাৎ, তাঁহার কোনও শিকড় নাই। তাঁহার বস্ত্রের বর্ণটি সেই নির্লিপ্ত, নির্লোভ চলিষ্ণুতার প্রতীক। পরম সহিষ্ণুতারও। কোনও কিছুর প্রতি আকৃষ্ট না হওয়াই যাঁহার ধর্ম, সহিষ্ণুতার মানদণ্ডে তিনি স্বভাবত উত্তীর্ণ। অথচ এখন গৈরিক বর্ণটি অসহিষ্ণুতার প্রতীকে পর্যবসিত। ক্ষমতার অসহিষ্ণুতা। যে অসহিষ্ণুতা, আক্ষরিক অর্থেই, ভয়ংকর। যে রং দেখিলে অতীতে শ্রদ্ধা জন্মাইত, আজ তাহা দেখিলে ভয় জন্মে। অতীতে পরিব্রাজক প্রশস্ত সময় দেখিয়া আকর্ষণহীন মুক্তযাত্রায় নিষ্ক্রান্ত হইতেন। এখন শিবরাত্রির দিন গৈরিকবসন যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে শুরু হইয়াছে রাম-রাজ্য যাত্রা। সেই যাত্রার নিহিত লক্ষ্য: ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন। ভয় হয়, জাতীয় পতাকায় গৈরিক বর্ণের মর্মও কি এ-বার বদলাইবে? সেই আশঙ্কা আছে বলিয়াই তিতিক্ষার বর্ণটিকে সংখ্যাগুরুবাদের গ্রাস হইতে রক্ষা করিবার প্রয়োজনও আছে। মথুরাপুরের স্কুলটির রং গৈরিক থাকিলে হয়তো সেই প্রয়োজনকে স্বীকার করা হইবে। স্কুলবাড়ি জানাইবে: গৈরিক কেবল ক্ষমতার রং নহে, উদার শিক্ষার রংও বটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy