৭ এপ্রিল হইতে ১৫ জুলাই। পঁচিশ বছর আগে রুয়ান্ডায় গণহত্যা চলে ঠিক একশো দিন। নিহত হন অন্তত আট লক্ষ মানুষ, প্রধানত টুটসি জনজাতির। হুটু জনজাতির ঘাতকদের ভয়াবহ আক্রমণ নামিয়া আসিয়াছিল তাঁহাদের উপর। কিছু অঞ্চলে প্রত্যাঘাতও ঘটে, কিন্তু তুলনায় অনেক কম। শত রজনীর অবকাশে আট লক্ষ প্রাণহানির এই পরিসংখ্যান জানাইয়া দেয়, সাহারার দক্ষিণবর্তী দেশটিতে কী বিপুল হিংস্রতা ও প্রচণ্ড বিদ্বেষ পুঞ্জীভূত ছিল। কিন্তু তাহার অকল্পনীয় পৈশাচিকতায় হতবাক হইয়া ভুলিলে চলিবে না যে, এই হিসাবের পিছনে ছিল এক দীর্ঘ ও নিবিড় প্রস্তুতিপর্ব, অনেকটা আগ্নেয়গিরির মতো। তবে আগ্নেয়গিরির সাজঘর থাকে দৃষ্টির অন্তরালে, রুয়ান্ডার সমাজে ও রাজনীতিতে হিংস্র বিদ্বেষের, কেবল লক্ষণ নহে, সুস্পষ্ট প্রমাণ দীর্ঘ দিন ধরিয়া জমা হইতেছিল। ১৯৯৪ সালের নিষ্ঠুর এপ্রিলে তাহার বিস্ফোরণ ঘটে।
এই হিংস্রতার পিছনে ছিল দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস। কিন্তু তাহার মূলে একটিই ব্যাধি। অমর্ত্য সেনের ভাষায় বলিলে: একক পরিচিতির ব্যাধি। পরিচিতি ও হিংসা (আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স) গ্রন্থে এবং তাহার আগে ও পরে বিভিন্ন লেখায় এবং বহু আলোচনায় তিনি দেখাইয়াছেন, বহুমাত্রিক পরিচিতিকে অস্বীকার করিয়া মানুষ যখন কেবল কোনও একটি সত্তার মাপকাঠিতে সব কিছু বিচার করিতে প্রবৃত্ত হয়, সেই সঙ্কীর্ণ ধারণা হইতে অনিবার্য প্রক্রিয়ায় জন্ম লয় অপরের প্রতি তীব্র ও হিংস্র অসহিষ্ণুতা— যে ‘আমার মতো’ নহে, তাহাকে দমন করিবার, দখল করিবার এবং ধ্বংস করিবার উদগ্র তাড়না। অধ্যাপক সেন এই ‘অদ্বৈতবাদী’ হিংসার নিদর্শন হিসাবে বিশেষ ভাবে রুয়ান্ডার ইতিহাস স্মরণ করিয়াছেন। দেখাইয়াছেন, সে দেশের অধিবাসীরা কী ভাবে নিজেদের অন্য সমস্ত পরিচয় ভুলিয়া শুধুমাত্র ‘হুটু বনাম টুটসি’ পরিচিতিতে নিজেদের সীমিত করিয়াছিলেন এবং তাহার পরিণতিতে চূড়ান্ত বিপর্যয় ডাকিয়া আনিয়াছিলেন।
লক্ষণীয়, ওই হিংসা ছিল প্রথমত ও প্রধানত সংখ্যাগুরুর হিংসা। এবং তাহাতে ইন্ধন দিয়াছিল ইতিহাসলালিত বঞ্চনাবোধ। রুয়ান্ডার শতকরা আশি ভাগের বেশি মানুষ জাতিপরিচয়ে হুটু। কিন্তু ষাটের দশকে স্বাধীনতার পর হইতে দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রগুলি ছিল বহুলাংশে সংখ্যালঘু টুটসিদের দখলে। সুযোগবঞ্চনা ও বৈষম্যের এই উর্বর জমিতেই বিষবৃক্ষের চাষ চলিয়াছিল কয়েক দশক যাবৎ। বিশেষত হুটুরা নানা উপায়ে সুপরিকল্পিত টুটসি-বিরোধী প্রচার চালাইয়াছিলেন। এ কালের সোশ্যাল মিডিয়া তখনও জন্মায় নাই, কিন্তু অন্য উপায়ের অভাব ছিল না। কমিউনিটি রেডিয়ো মারফত বিদ্বেষী প্রচার ছিল আক্ষরিক অর্থেই সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী। ‘আরশোলা মারিবার’ প্ররোচনা, ‘উঁচু গাছ কাটিয়া ফেলিবার’ নির্দেশ (টুটসিরা সাধারণত হুটুদের তুলনায় দীর্ঘকায়)— ভিন্ন পরিচিতির মানুষকে মনুষ্যেতর হিসাবে প্রতিপন্ন করিবার এই দুষ্কীর্তি ইতিহাস বহু বার দেখিয়াছে, ত্রিশের দশকের জার্মানি হইতে দেশভাগের ভারত, ১৯৮৪ সালের দিল্লি হইতে ২০০২-এর গুজরাত, ঘরে ও বাহিরে অজস্র নজির। সঙ্কীর্ণ পরিচিতিবোধের জঠর হইতে সঞ্জাত হিংস্র বিদ্বেষ কোথায় পৌঁছাইতে পারে, পঁচিশ বছর আগের রুয়ান্ডা তাহা আমাদের শিখাইয়াছে। আমরা কতটা শিখিয়াছি, তাহা অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy