মধ্যরাত। বাবা আর ভাই বারান্দায় বসে আছেন। চোখের পাতা এক করা যাচ্ছে না। ওড়না সিলিং ফ্যানে জড়িয়ে যে কোনও মুহূর্তে গলায় ফাঁস দিতে পারে রেশমা। দীর্ঘ চার মাস পরে সে বাথরুমের আয়নায় নিজের মুখ দেখে ফেলেছে। চিৎকার করেছে, বাড়ির লোককে গালমন্দ করেছে, গুম মেরে গেছে, তার পর আত্মহত্যা করবে ঠিক করেছে। সেই চিন্তায় বাড়ির কারও ঘুম নেই।
দিদিকে জামাইবাবু মারত। তাই তাকে নিজেদের কাছে নিয়ে চলে এসেছিল রেশমারা। জামাই বদলা নিল শিশু সন্তানকে কেড়ে নিয়ে। মামলা হল। তাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার রায় যে দিন বেরোবে, সেই দিন দিদিকে মারতে গিয়ে জামাইবাবু অ্যাসিড ছুড়ে বসল বোনের দিকে। ইলাহাবাদের ঘটনা। স্টেশনের কাছের জনবহুল এলাকা। তবু হাজার চিৎকারেও কেউ এল না সাহায্য করতে। শেষে অচেনা এক বাইক-আরোহী হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। হাসপাতাল ভর্তি করল না। এর পর থানা পুলিশ। তিন ঘণ্টা পরে হাসপাতালে রেশমার জায়গা হল, চামড়ার সঙ্গে মাংস গলে গলে পড়ছে।
ন’মাস রেশমা কারও সঙ্গে কথা বলেনি। কাঁদতেও হত এক চোখে, অন্যটা গলে গেছে। শেষে রিয়া শর্মার হাত ধরে জীবনে প্রত্যাবর্তন। মডেল হয়েছে। হেঁটেছে নিউ ইয়র্কের ফ্যাশান শো’য়।
রেশমা এক বিপর্যয়ের নাম। বিপর্যয়কে অতিক্রম করারও নাম। অ্যাসিড হামলা পৃথিবীর অনেক দেশে হয়। ভারত তালিকায় উপরের দিকে। বাংলাদেশে এই অপরাধ আগে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় হত। এখন অনেকটা কমেছে। ভারতে কিন্তু বেড়েই চলেছে। ‘অ্যাসিড সারভাইভর ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’ (এএসএফআই) বলছে, ২০১৪ সালে ভারতে ৩৪৯টি অ্যাসিড হামলা হয়েছিল। ২০১৫’য় ৫০০-র বেশি। একটি হিসেবে, এখন ভারতে বছরে প্রায় হাজার খানেক এই ধরনের ঘটনা ঘটে।
অ্যাসিড হামলা মূলত মেয়েদের উপর ঘটে এবং কারণগুলোও মোটামুটি সবার জানা। বিবাহবিচ্ছেদ, একতরফা প্রেম, পুরুষের ইগো, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদ, পারিবারিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে অশান্তি। ভারতে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিড হামলা হয় উত্তরপ্রদেশে, বছরে প্রায় ৬১টি। এর পরেই আমাদের রাজ্য। এএসএফআই-এর হিসেবে বছরে ৪১টি। দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, বিহারও কম যায় না।
এখন সময় ফিরে দাঁড়ানোর। শুধু যে পীড়িত তার নয়, তার চার পাশের মানুষজনেরও। এত দিন শুধু ঘৃণা ছিল, বর্জন ছিল। আজ আলোক দীক্ষিতের মতো সমাজকর্মীরাও আছেন। কানপুরের আলোক তাঁর সংগঠনের প্রচেষ্টায় ‘স্টপ অ্যাসিড অ্যাটাক’ স্লোগানকে জীবন দিয়েছেন। বিবাহ করেছেন লক্ষ্মী অগ্রবালকে। লক্ষ্মী এক দিন অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছিলেন। এখন তিনি এক কন্যাসন্তানের মা, অ্যাসিড-বিরোধী যুদ্ধের সেনাপতি। অ্যাসিড-জয়ী নারীদের নিয়ে কাফেও খুলেছে এ দেশের তিনটি শহরে। কাফের নাম ‘শিরোজ হ্যাংআউট’।
ছোটবেলায় এয়ারহোস্টেস হতে চাইত সোনিয়া। ২০০৪ সালে সামান্য মোবাইল নিয়ে গন্ডগোলে পাড়ার এক ভাই বাড়ির সামনে অ্যাসিড ছোড়ে তার মুখে। তার পর সেই চিৎকার, হাসপাতাল, জীবন্মৃত জীবন, আত্মহননের চেষ্টা, শেষে লড়াই। এখন সে বিউটিশিয়ান। আগে ক্যামেরা দেখে ভয় পেত। আজ ক্যামেরা তার নিত্যসঙ্গী। এখন একটি বাচ্চা অনাথ আশ্রম থেকে এনে মানুষ করছে সে। বাচ্চাটি তাকে ভয় পায় না, ভালবাসে। অ্যাসিডের শিকারদের প্রতি সোনিয়ার আবেদন: মুখে ওড়না দিয়ো না। লজ্জা তাদের, যারা অ্যাসিড ছুড়েছে। লজ্জা তোমাদের নয়।
অ্যাসিড হামলাকে ‘বিশেষ অসামাজিক অপরাধ’ বলে মানতে ভারতকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। অথচ আফগানিস্তান ২০০৯ সালে, পাকিস্তান ২০১২ সালে, বাংলাদেশ ২০০২ সালেই বিশেষ আইন পাশ করেছে অ্যাসিড হামলার মোকাবিলায়। বাংলাদেশে তো শুধু কারাবাস নয়, মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হয়। ভারত ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩২৬এ এবং ৩২৬বি ধারায় অ্যাসিড হামলাকে দণ্ডবিধিতে আলাদা একটি ‘সেকশন অব অফেন্স’ দেওয়ার আইন পাশ করায়। অপরাধীর ১০ বছর জেল ও ১০ লক্ষ টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়। তবু অ্যাসিড হামলা বেড়েই চলেছে।
অ্যাসিড এখনও সুলভ ও সস্তা। তার বিক্রি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। অপরাধী যেন আইনের ফাঁক গলে বেরোতে না পারে, তার উচিত শাস্তি হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অ্যাসিডের শিকারদের জন্যে বিশেষ চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সময় নষ্ট না হয়। থানা যাতে কেস নিতে বাধ্য হয়, তা দেখতে হবে। রোগী ও তার পরিবারের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। গণসচেতনতা চাই, যাতে ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। বেঁচে ওঠা মানুষটিকে পেশাগত সুবিধা দিতে হবে। এমন অনেক দাবি আছে সমাজকর্মীদের।
সরকার কবে এ সব দাবি পূরণ করবে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কিন্তু আমরা? কিছু দিন আগে একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। গঙ্গা-গোমতী এক্সপ্রেসে অ্যাসিড হামলা হয়েছিল এক মহিলার উপর। হাসপাতালে চিকিৎসা চলাকালীন তাঁরই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মহিলা পুলিশকর্মীরা তাঁর ঝলসানো শরীর সামনে রেখে সেলফি তুলছিলেন। এই মহিলা এর আগেও এক বার গণধর্ষণ ও তিন বার অ্যাসিড হামলার শিকার হন।
এই ভিডিয়ো উন্নত প্রযুক্তির প্রমাণ, না বর্বরতার ইতিহাসের অন্যতম দলিল, আমরা জানি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy