ষষ্ঠবর্ষীয় বালকের আস্ফালনে ডাক্তারবাবু হতচকিত ভাবটা সামলানোর আগেই সে ঝটিতি তাঁর হাত থেকে সিরিঞ্জটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে তীব্র একটি গালি দেয়। বালকের মা তার মুখ চেপে ধরে ডাক্তারের কাছে মিনতি শুরু করেন, যাতে তার আচরণের কারণে তার চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া না হয়। অসুখ গুরুতর, বহু কষ্টে লাইন পাওয়া গেছে। চিকিৎসা অনেক আগেই শুরু হওয়ার দরকার ছিল, সরকারি হাসপাতালে রোগীর ভিড়ের চাপে ‘স্বাভাবিক’ বিলম্ব হয়েছে। সুসংস্কৃত নান্দনিক পরিমণ্ডলে বড় হয়ে ওঠা সদ্য-ডাক্তার যুবকটি তখন কথা শুনবার অবস্থায় নেই। সবে চাকরিতে ঢুকলে কী হবে, দৈনিক যে সংখ্যায় রোগী দেখতে হয় তাতে অভিজ্ঞতা কিছু কম জমেনি। কিন্তু প্রায় দুধের শিশুর মুখে এমন দুষ্কথন ডাক্তাবাবুর কল্পনার অতীত।
কিন্তু বাস্তবিকই কি এতে খুব আশ্চর্যের কিছু আছে? পথে-প্রান্তরে, রেলগাড়ির কামরা বা গ্রামের বিদ্যালয় থেকে কলেজ ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে, থানায়-আপিসে সর্বত্র মধুবর্ষণ। ‘শালা’—যা নাকি আদতে সম্ভাষিতের ভগ্নীর সঙ্গে রমণেচ্ছা— আজ আমাদের ভাষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ‘ইয়ে’, ‘মানে’, ‘বাপ রে’, ‘মা গো’ ইত্যাদি যে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহৃত হয়, ‘শালা’ও তাই। পুরুষাঙ্গের এক কথ্যরূপ অধুনা যেন বা বাংলা ভাষায় নতুন এক বিরামচিহ্ন। শিশু তো শুনে শেখে, সে শোনার মধ্যে শুধু ‘মা’ ডাকটাই তো নেই, যা শুনলে একদা ‘ভদ্র’ বাঙালি কানে আঙুল দিত সে রকম অজস্র শব্দ অহরহ তার কানে ঝংকৃত হচ্ছে। সে শিখছে।
সুহৃদ ও পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই এই অকথা-কুকথা-র ধারা-প্রবাহকে বঙ্গসংস্কৃতির রসাতলগমন মনে করেন। আবার কেউ কেউ একে একটা ইতিবাচক সমাজ পরিবর্তনের লক্ষণ মনে করেন। প্রথম অংশটি নগরবাসী, কিংবা নাগরিক প্রভাবাচ্ছন্ন। এঁদের কথাগুলো অক্ষমের নিষ্ফল ক্রন্দন। দীর্ঘ কাল সুখে দিন কাটানোর পর, অকস্মাৎ ক্ষমতাবৃত্ত থেকে ছিটকে পড়া এই বাগ্জীবী শ্রেণিটি দিশাহারা। অন্তর্মথনের অভ্যাস নেই, আগ্রহও নেই। অতএব, সব দোষ গিয়ে পড়ছে বর্তমান শাসকদের উপর। অন্য দিকে, দ্বিতীয় অংশটি বিশ্বাস করেন, আলোকায়নের ভাবধারায় পুষ্ট মহানাগরিক বাংলা নিজেকে যে প্রান্ত বাংলা থেকে এত কাল বিচ্ছিন্ন রেখেছে, এবং যাকে অবদমিত রেখেছে, সেই বাংলা আজ রাজনৈতিক ভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তার প্রভাব, অতএব, সামাজিক ক্ষেত্রে পড়তে বাধ্য। যুক্তিটা ফেলে দেওয়ার নয়। ক্ষমতার অপব্যবহারকে দ্রুত অভ্যাসে পরিণত করে ফেলা বামপন্থীরা প্রশাসনিক রাজনীতিকে ধ্যান-জ্ঞান করে তুলে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে উন্নততর করার জরুরি কর্তব্যটা বিস্মৃত হলেন। যেখানে প্রধান কাজটা ছিল লোকসমুদয়কে সম্মানের সমতায় রাজনীতির বৃত্তে নিয়ে আসা, সেখানে কাজটা হয়ে দাঁড়াল অভিভাবকত্ব। জনগণ নাবালক, তারা নিজের ভালমন্দ বোঝে না, সুতরাং পার্টি নামক অগ্রণী বাহিনীকে সেই দায়িত্বটা নিতে হবে। এই বোধ থেকেই বোধহয় জন্ম নিয়েছিল একটা অনুজ্ঞা: জনগণকে সহজ ভাষায় বোঝাতে হবে।
এখানে একটা মস্ত সমস্যা তৈরি হল। প্রথম, সামুদায়িক রাজনীতির মতো একটা জটিল ব্যাপারকে সহজ ভাবে বোঝানো সহজ নয়, সে ভাষা আয়ত্ত করতে নিরবচ্ছিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিগত অনুশীলন দরকার হয়, এবং সে অনুশীলনটাকে হতে হয় সামূহিক, ব্যাপক আদানপ্রদানভিত্তিক, যাতে সমাজের নানা পক্ষ, দলীয় নেতা-কর্মী থেকে নিয়ে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার যোগ্যতা অর্জন উঠতে পারেন। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, রাজনীতির প্রত্যক্ষ কর্মীদের যেমন জনগণের ভাষা বুঝতে শিখতে হবে, তেমনি চাষি-মজুর-ব্যাপারি-ছাত্র-গৃহবধূদেরও রাজনীতির ভাষায় সড়গড় হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করাটাকে অবশ্যকর্তব্য মানতে হবে। কিন্তু, ক্ষমতার তুলনামূলক নিশ্চয়তা যেহেতু গণসম্পর্কের বদলে একটা প্রজাসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করে দিল, অচিরে এক প্রকার আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা সামাজিক-রাজনৈতিক ভাষাচর্চার সম্ভাবনাকে অবলুপ্ত করল। ফলে সমাজ তার মতো করে রাজনীতির সঙ্গে আপস করে নিজের ভাষা গড়ে তুলল। খেয়াল করলেই দেখা যায়, সাংস্কৃতিক মানের অবনতির চিহ্ন হিসেবে যে ভাষা-ব্যবহারকে শনাক্ত করা হয়ে থাকে, সে ভাষা কিন্তু ক্ষমতারই ভাষা। আধার হিসেবে এ ভাষা বেছে নিয়েছে সহজতম, প্রাচীনতম এক নিপীড়নকে— নারীর উপর পুরুষের অত্যাচার।
বাংলার শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আমরা সংগত কারণেই গর্ব করে থাকি। সেই চর্চাতেও কিন্তু এই যুক্তিবিচ্ছিন্নতার প্রভাব স্পষ্ট। জনগণের ভাষায় কথা বলার এমন বহু নমুনা আছে, যেগুলো স্পষ্টত লিঙ্গ-বিদ্বেষ, বা অন্য প্রকার সামাজিক বিভেদকে মহিমান্বিত করে চললেও নিন্দিত না হয়ে জয়ধ্বনি পেয়ে এসেছে। মাতা বা ভগিনীদের সঙ্গে বলাৎকারী সম্ভোগেচ্ছার দাম্ভিক ঘোষণার সূচক গালাগালিগুলো মহানগরের নাটমঞ্চে, কবিতা-উপন্যাসে ‘সমাজ-বাস্তবতা’র অভিজ্ঞান হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে এসেছে। প্রশ্ন ওঠেনি, এ বাস্তবতাকে উদ্যাপন করব, না পরিবর্তন করার জন্য উদ্যোগী হব। এখানেও রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সামাজিক রাজনীতির পরিপূরক বিচ্ছিন্নতা। ফলিত রাজনীতির লোকসমাজের ওপর কর্তৃত্ব সামাজিক সংস্কৃতিকেও আত্মবঞ্চিত করেছে ।
স্বাভাবিক রাজনৈতিক বোধে বর্তমান শাসক দলের নেত্রী রাজনীতি ও সমাজের মধ্যবর্তী এই সংলাপের ফাঁকটিকে সহজেই ধরতে পেরেছেন, এবং নিজের রাজনৈতিক পরিচিতিটাকে সামাজিক ছাঁচের সঙ্গে এমন ভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন যাতে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ বার্তাটি নগরায়িত সাংস্কৃতিক বৃত্তের বাইরে থাকা তথাকথিত নিম্নবর্গের লোকেদের কাছে নির্ভুল ভাবে পৌঁছে যায়। যে বাক্-ব্যবহারের কারণে তিনি নগর-সভ্যদের কাছে ধিক্কৃত হন, সেই ‘স্পষ্টকথন’ তাঁর জন্য গ্রাম্যবাংলার আনাচকানাচ থেকে বিপুল সংবর্ধনা সংগ্রহ করে আনে। তিনি জানেন এটাই ‘সমাজবাস্তবতা’। লোকে এই ভাষা বোঝে, এই ভাষায় কথায় বলে, আর তাই, তাঁর দৃশ্যরূপায়িত ‘বাঁশ দেওয়া’ মুহুর্মুহু করতালিতে বাংলার রেনেশাঁস নান্দনিকতাকে কলা দেখিয়ে আপনবেগে বইতে থাকে। তিনি যে সহজিয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাহক, সামাজিক সংস্কৃতির অপরিশীলিত রূপটা তার চমৎকার পরিপূরক।
রাজনীতি ও সমাজের সমীকরণ ঘটানোর কাজটি দুরূহ। পশ্চিমবঙ্গের মতো একটা জায়গায় সেটা করার জন্য আরও অনেক কিছুর সঙ্গে নগর ও গ্রামের দূরত্ব ঘোচানো, তাদের মধ্যে সহজ, স্বাভাবিক, সম্মান-নির্ভর সম্পর্ক স্থাপনের কাজটা একান্ত জরুরি। কিন্তু, কঠিন রাস্তায় যাওয়ার ভবিষ্যদ্দৃষ্টি যে রাজনীতি দেখাতে পারে আমাদের রাজনীতি তার অনুশীলনে অভ্যস্ত নয়। ক্ষমতাসীন নেত্রী তাই নগর ও গ্রামের দূরত্ব কমাতে সাংস্কৃতিক উত্তরণের বদলে গ্রাম্যতার সংস্কৃতিকেই পাথেয় করে নিলেন। সফলও হলেন। সাফল্য কী ভাবে চিন্তার পথ রুদ্ধ করে বামফ্রন্ট সরকারের স্থবির পতনের মধ্য দিয়ে তা পরিস্ফুট। শাসকের সমস্যা হল অতীত বা ভবিষ্যতের সঙ্গে তার ভাবনার বড় একটা যোগ নেই, সে বর্তমানে বাঁচে, কিন্তু বর্তমানেই যে তার প্রয়াণও নিশ্চিত হতে থাকে সেটা তার মনোজগতে ধরা পড়ে না। পড়লে, বর্তমান শাসক দলের নেত্রী দেখতে পেতেন, কী ভাবে তাঁর ‘উদ্ভাবিত’ সহজিয়া পথটা এমন কারও দখলে চলে যাচ্ছে, যে নাকি এ পথ ব্যবহারে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ, কেননা এ পথটাই তার একমাত্র পথ। যুক্তিহীনতা, মতান্ধতা, জবরদস্তির মতো সহজতম পথেই যে দলটা দিল্লির সিংহাসন দখল করতে পারে, বাংলার শাসনক্ষমতা অধিকারের স্বপ্ন দেখতে তার বাধা কোথায়? লক্ষণীয়, বিজেপি এ রাজ্যে যে নেতৃত্ব বেছে নিয়েছে তা সাংস্কৃতিক গ্রাম্যতারই পরাকাষ্ঠা। স্বচ্ছন্দ অশালীনতায় রাজনীতির চর্চাতে সে নেতৃত্বের জুড়ি নেই। সহজ পথের রাজনীতিতে এ নেতৃত্বকে ঠেকানোর ক্ষমতা অন্যদের নেই।
সময়ের কিছু দাবি থাকে, মানবসভ্যতার কিছু চাহিদা থাকে। যে বিশ্বে সময় ও মানুষ জটিল বুননে একাকার, সেখানে আঁকাবাঁকা পথেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির যাত্রা। গ্রাম ও নগরকে সুযোগসাম্যের ভিত্তিতে সংযুক্ত করার কাজটা তার প্রথম ধাপ—সাংস্কৃতিক গ্রাম্যতা এবং নাগরিক আধিপত্য, উভয় বোঝাকে ঝেড়ে ফেলেই সে পথে এগোতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy