জনতার শুভেচ্ছার জোয়ারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ বার ভোটের সময় বুথ ফেরত সমীক্ষা প্রকাশের এক সপ্তাহ আগে এই ‘শাহি সমাচার’-এ আমি লিখেছিলাম, যে যা-ই বলুন আমি কিন্তু এখনও তাল ঠুকে বলতে পারছি না, কংগ্রেস-সিপিএম জোট সরকার গড়বে। এ কথাও লিখেছিলাম, গত পাঁচ বছরে তৃণমূল সরকার সম্পর্কে নানা স্তরে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তাই বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করতে পারবেন না, এমনটা আমি কোনও যুক্তি দিয়ে মেনে নিতে পারছি না। এই লেখাটিও আমি লিখতাম না। কিন্তু লন্ডন থেকে বিবিসি-র সাংবাদিক বন্ধু তীর্থঙ্কর আমায় প্ররোচিত করে একটি বার্তা পাঠায়, why this stoic silence of Jayanta Ghosal? এমনটা তো কোনও ভোটেই হয়নি। কর্মসূত্রে দিল্লিতে বিভিন্ন বৈদ্যুতিন চ্যানেলে পশ্চিমবঙ্গ বিশেষজ্ঞ হিসাবে যেতে হয়েছিল, সেখানেও বারংবার বলেছিলাম, মমতাই জিতবে। এমনকী, ১৯ মে ভোটের ফল প্রকাশের সকালে এবিপি নিউজ হিন্দি চ্যানেলে এক উত্তর ভারতীয় বিশেষজ্ঞ শ্রেষনারায়ণ বলেছিলেন, দেওয়াল লিখন পরিষ্কার। কংগ্রেস-সিপিএম জোট সরকারে আসছে। মমতার বিদায়ঘণ্টা বেজে গিয়েছে। মহীরুহ পতনের সাক্ষী হতে চলেছি কয়েক ঘণ্টা পর। লাইভ অনুষ্ঠান, বিশাল প্যানেল সকলের সামনে বলেছিলাম, উনি বোধহয় পশ্চিমবঙ্গ আমার চেয়ে ভাল বোঝেন! মমতা আবার মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন কয়েক ঘণ্টা পর।
হে পাঠক, আমায় ভুল বুঝবেন না। আমি নিজের ঢাক নিজে পেটাতে চাইছি না। আনন্দবাজার পত্রিকায় গত তিন মাসে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন, মমতা বনাম জোট নিয়ে একটি প্রতিবেদনও আমি লিখিনি। কিন্তু শাহি সমাচারের লেখাটি ফেসবুক এবং টুইটে শেয়ার করার পর এক জোট সমর্থক বন্ধু আমার লেখাটি সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘‘জয়ন্ত ঘোষাল মমতার কুকুর। ওঁর কথার কোনও দাম নেই। আপনারা ওঁর কথা বিশ্বাস করবেন না।’’ সেই মন্তব্যটিতে আমি সে দিন ‘লাইক’ করেছিলাম এবং হেসেছিলাম। কিন্তু আজ বড় দুঃখের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি, ২০০৬ সালে বুদ্ধবাবু আবার জিতে ফিরে আসার পরে লিখেছিলাম, ‘এক নতুন সিপিএমের স্বপ্ন দেখছে মানুষ। বুদ্ধবাবুকে আরও সময় দিতে চায় বঙ্গবাসী।’ সে দিনও এমন কিছু গোঁড়া দলীয় সমর্থক মন্তব্য করেছিলেন, বুদ্ধবাবুর রাজনৈতিক দায়িত্ব যেন আমরা নিয়েছি। সমস্যাটি এখানেই। তথ্য সংগ্রহের জন্য মুখ্যমন্ত্রী তথা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার ঘনিষ্ঠ হওয়াটা সাংবাদিকের কাজের মধ্যে পড়ে। প্রফুল্ল সেন যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন তিনিও সাংবাদিকদের গাড়িতে নিয়ে ঘুরতেন। মুড়ি-বাদাম নিজে হাতে বানিয়ে খাওয়াতেন। গান শুনতেন। প্রফুল্ল সেনের সচিব শরৎ চক্রবর্তীর রচনা পড়লে এই তথ্য জানা যায়।
সংসদের সেন্ট্রাল হলে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘‘তোমার অবস্থাটা এখন যোধাবাঈয়ের মতো। আকবরের সঙ্গে যখন তাঁর ভাইয়ের যুদ্ধ শুরু হয় তখন যোধাবাঈ বলেছিলেন, যুদ্ধের আগেই তিনি পরাস্ত। কারণ যুদ্ধে এক জন হারলেই সেটা তাঁর হার। এক দিকে তুমি আনন্দবাজার। আর অন্য দিকে তুমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক।’’ অরুণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ব্যক্তিগত ভাবে তুমি মমতাকে ক’টা আসন দেবে? মমতা যে দু’শো আসন পাবে তা আমি ভাবতে পারিনি। বলেছিলাম ১৭০+ আসন পাবে। এনডি টিভি-র সুনীল প্রভু-সহ আরও অনেক সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের একটি বড় অংশ সে কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। আমাকে সমর্থন করেছিলেন কেবল রাজদীপ সরদেশাই।
শেষ পাতের প্রশ্ন, এত প্রবল বিরোধিতার মধ্যেও মমতা জিতলেন কী করে? কংগ্রেস-সিপিএম জোট মমতার প্রতিপক্ষ ছিল। বিজেপি মমতার প্রতিপক্ষ ছিল। প্রতিটি সংবাদপত্র স্বীকার করেছে, নির্বাচন কমিশন এ বার রিগিং হতে দেয়নি। বিরোধী দলগুলিও কমিশনের ভূমিকায় গদগদ ছিল। ভোটের ফল বার হওয়ার পরে কোনও রাজনৈতিক দল এখনও রিগিং-এর অভিযোগ করেনি। অভিমন্যু চক্রব্যূহ থেকে বেরোতে পারেননি। কিন্তু মমতা পেরেছেন। সিপিএম বলছে, বিজেপির ভোট কমেছে। মমতার ভোট বেড়েছে। বিজেপির ভোট জোটের দিকে স্থানান্তরিত হয়নি। উল্টে মমতাকে জিততে সাহায্য করেছে। গণশক্তিতে এই যুক্তিতে একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। গণশক্তির এক প্রাক্তন সাংবাদিক অরিজিৎ উপাধ্যায়, যিনি নির্বাচনী প্রচারের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় জোটের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন, সেই অরিজিৎ এই লেখাটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, বিজেপি তো বিজেপির কাজ করবে। বিজেপির দায়িত্ব তো সিপিএমকে জেতানো ছিল না। আর বিজেপিকে নিয়ে যখন এতই শঙ্কা তখন সাম্প্রাদায়িকতার অভিযোগ ভুলে গিয়ে বিজেপির সঙ্গেই জোট করতে পারত সিপিএম। এখন হেরে গিয়ে বিজেপিকে দোষ না দিয়ে নিজেদের ভুল-ত্রুটিগুলি খুঁজে বার করা অনেক বেশি জরুরি।
অনেকেই বলছেন, মমতার ভোটে জেতার কারণ বাঙালির অবনয়ন। দুর্নীতিতেও বাঙালির কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। তারা নারদের ছবি দেখেও মমতাকেই ভোট দেন। বেকার, বঞ্চিত, দুঃখী মানুষ এখনও মমতা নির্ভর। তারা বেকার ভাতা পায়। ছাতা পায়। সাইকেল পায়। কাজেই এ হল প্রান্তিক মানুষের কৃতজ্ঞতার ভোট। তাই যদি হয় তা হলে কলকাতার অভিজাত এলাকায় কী ভাবে প্রত্যেকটি আসনে মমতা জেতেন! অভিজাত সল্টলেক বা গড়িয়াহাটের বাসিন্দাদের কৃতজ্ঞতা কীসের জন্য? মমতা পাঁচ বছর রাস্তায় গান শুনিয়েছেন সে জন্য! নাকি ত্রিফলার আলোর জন্য! নাকি নীল-সাদা রঙে কলকাতাকে রাঙানোর জন্য! আসলে আমার মনে হয়, মমতা আজও পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয়তম নেত্রী। সিন্ডিকেট, নারদ, লুম্পেনাইজেশন— এ সবে মানুষের অসন্তোষ বেড়েছে। কিন্তু মানুষ এখনও মমতার উপর ভরসা হারাননি। সূর্যকান্ত মিশ্রকে মমতার বদলে বিকল্প নেতা হিসাবে মানুষ গ্রহণ করেননি। ৩৪ বছরের বাম শাসনে মানুষের যে ঘৃণা তা মানুষের মন থেকে সিপিএম এখনও দূর করতে পারেনি।
মমতা মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আগামী ২৭ মে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করতে চলেছেন। আগামী পাঁচ বছর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ। আবার এক নতুন পথ চলা। তার মধ্যে তিন বছর পরে আসছে লোকসভা নির্বাচন। আশা করব শুধু তৃণমূলের নয়, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে উঠবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy