ডাকিনির দাঁতগুলো হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে যত্ন করে ঠুকে ঠুকে ধারালো করছিলেন শঙ্কর সরকার, ‘মহিষবাথান হস্তশিল্প সমবায় সমিতি’র দোতলার খোলা ছাদে বসে। প্রবীণ মানুষটি বুঁদ হয়ে আছেন কাঠের মূর্তিটার মধ্যে। “এই যে দেখুন, ডাকিনির দাঁতগুলো বার করা থাকবে, জিভ থাকবে কালীরই মতো কিন্তু দেখতে অনেক ভয়ানক হবে। কান হবে কুলোর মতো। মাথায় পাহাড়-পাহাড় মুকুট। মুখে কালো বা নীল রঙ করতে হবে। এখন অবশ্য অনেকে লাল-হলুদও করছে। আবার যখন চণ্ডী বানাবেন তখন চোখ দুটো একটু ঢোকা মতো হবে।” শতরঞ্চিতে ছড়িয়ে বসে কাজ করছেন আট-দশজন শিল্পী। ঘিরে বসে দেখছেন দেশি-বিদেশি অতিথি অভ্যাগতেরা। কেউ কেউ উত্সাহ নিয়ে হাতও লাগাচ্ছেন, রঙ বুলোচ্ছেন।
মাস কয়েক আগের কথা। কালিয়াগঞ্জ স্টেশন থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে কুশমন্ডি ব্লকের মহিষবাথান গ্রামে তিন দিনের মেলা বসেছিল। ‘মুখামেলা’। মুখোশ থেকে ‘মুখা’। পিচঢালা কুশমন্ডি রোডের এক ধারে সমিতির অফিস, অন্য ধারে বড় মাঠ। মাঠের মাঝখানে স্টেজ হয়েছে। তিন সন্ধে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মূল আকর্ষণ ‘গমীরা নাচ’। ঢাক, কাঁসর, সানাইয়ের সঙ্গে ডাকিনি, নররাক্ষস, কালী, ভদ্রাকালী, রাবণ, হনুমান, বুড়োবুড়ি, জটায়ু, হনুমান, বাঘের মুখোশ পরে নাচবেন গমীরা নর্তকেরা। মাঠের এক পাশে ছোট ছোট স্টলে বিক্রি হবে সেই সব মুখোশ।
কুশমন্ডির রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোকাচার ও ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কাঠের মুখোশ আর মুখা নাচ। বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাসের মধ্যে চণ্ডীপুজো, সেই পুজোয় মুখানাচ হবেই। আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের নর্তকেরা নেহাত সস্তা কাপড়ের, হাতে সেলাই করা ঘাঘরা-র মতো ড্রেস পরেন। দেবতাকে মুখোশ মানত করেন গ্রামের মানুষ। কুশমন্ডি ব্লকের মধুপুর, মঙ্গলদহ, আটিয়া, মহিষবাথান, বেলডাঙা, সিঁদুরমুছি, সরলা, রুয়ানগর, শবদলপুর, শিয়ালা গ্রামেই মূলত থাকেন মুখোশনির্মাণ শিল্পীরা, এখন কমতে-কমতে যাঁদের সংখ্যা একশো চল্লিশ জনের কিছু বেশি। সময় এগিয়েছে। শুধু লৌকিক আচার বা ধর্মীয় প্রয়োজনে মুখোশ তৈরি না করে সৃষ্টিশীলতার স্বীকৃতি পাওয়া এবং একে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার একটা তাগিদ তৈরি হয়েছে এই শিল্পীদের মধ্যে। কারুজ্ঞান আর প্যাশন সম্বল করে মুখোশকে বিকল্প আয়ের উত্স হিসাবে গড়ে তোলার কঠিন লড়াইটা চলছে গত প্রায় দু’দশক ধরে। ২৪ বছর আগে মহিষবাথান হস্তশিল্প সমবায় সমিতি তৈরি করেছিল সরকার। শিল্পীরা সেখানেই একজোট হতে লাগলেন। নতুন ছেলেদের মুখোশ তৈরি শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হল শঙ্কর বুড়া-র মতো কিছু প্রবীণকে।
কিন্তু বাণিজ্যিক প্রয়োজনে যতটা ঝকঝকে, স্মার্ট মুখোশ গড়তে হয়, তখনও শিল্পীদের সেই ধারণা ছিল না। অনেকেই কম দামে স্লিক মুখোশ খুঁজতেন যা শিল্পীরা দিতে পারতেন না। অনন্ত সরকার বললেন, “কিস্যু বিক্রি হত না। তা-ও কেমন নেশায় পড়েছিলাম। কত দিন বাড়িতে হাঁড়ি চড়ত না। বউ গাল দিয়েছে, মুখোশ উনুনে ফেলে দিয়েছে। কত বার ছেলের গা ছুঁয়ে দিব্যি খাইয়ে চাষবাস করতে বলেছে। আমি ওকে বোঝাতাম, এ কাজে হয়তো ধন নেই, কিন্তু মান রয়েছে প্রচুর। কিন্তু ছেলেপুলের সংসারে শুধু মানে চলে না। পেট চালানোর চিন্তাটাও ধাক্কা দিত।”
সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে পরিস্থিতি বদলাল। সমিতি থেকে সরকার মুখোশ কিনতে শুরু করেছিল। বিভিন্ন মেলায় তা বিক্রির জন্য পাঠানো শুরু হল। কিছু আর্ট গ্যালারি, দোকান বা সংগ্রহাকরাও জিনিস নিতে শুরু করলেন। কিন্তু তখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি ছিল। কাঁচামালের সমস্যা, মহাজনের দাপট, প্রচারের অভাব, বিপণনের দুরবস্থা। অন্য জেলায় বা অন্য রাজ্যের মেলায় যেতেও তাঁদের সমস্যা। কারণ অতটা চলিয়ে-বলিয়ে নন তাঁরা, বাংলাটাও ভাল করে বলতে পারেন না তো হিন্দি-ইংরাজি কোন ছার। ট্রেনে মাল ওঠানো-নামানো, মেলার আয়োজকদের সঙ্গে কথাবার্তা, ক্রেতাদের সঙ্গে দরদস্তুরে প্রচণ্ড সমস্যায় পড়েন।
বছর দেড়েক আগে পরিস্থিতি খানিকটা বদলাল। রাজ্য সরকার ‘মহিষবাথান হস্তশিল্প সমবায় সমিতি’কে ৫ লক্ষ টাকা অনুদান দিল। ঠিক হল, সেই টাকা থেকেই কাঠ কিনে মুখোশ বিক্রির পর সমিতিকে টাকা ফেরত দেবেন শিল্পীরা। পরের বার বরাত পেলে সেই টাকাই আবার কাঠ কিনতে ব্যবহার করা যাবে। মহাজনের ঋণে জর্জরিত হওয়াটা একধাক্কায় অনেক কমল। এগিয়ে এল ইউনেস্কো। প্রশিক্ষণ থেকে বিপণন, নানা স্তরে কাজ করার জন্য ইউনেস্কোই নিয়োগ করল ‘বাংলানাটক ডট কম’ সংস্থাকে। গত কয়েক বছর ছ’টি জেলায় নানা লোকশিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩২০০ শিল্পীর উন্নয়নের কাজ করছিল এ সংস্থা। দেড় বছর আগে সেই তালিকায় যুক্ত হন কুশমন্ডির মুখোশশিল্পীরা।
মেলার মাঠে বসে দেড় বছরের চেষ্টার কাহিনি শোনাচ্ছিলেন বাংলানাটক ডট কমের কর্ণধার অমিতাভ ভট্টাচার্য। প্রথমেই শুরু হয় যুগোপযোগী মুখোশ তৈরির প্রশিক্ষণ। কোন ধরনের আঠার সঙ্গে কী রকম রং মিশিয়ে মুখোশে লাগালে রং ঘাঁটবে না, মুখোশের আকৃতি কী রকম হলে শহরের ক্রেতাদের পছন্দ হবে, এই সব। এখন মুখোশের আকারে ছোট-ছোট শো পিস, পেনহোল্ডার, চাবির রিং, ফ্রিজ ম্যাগনেট তৈরি করা হচ্ছে। দাম বেশ কম। চাহিদা দুরন্ত। বিভিন্ন মেলায় শিল্পীদের নিয়ে গিয়ে কী ভাবে কথা বলতে হবে, ক্রেতাদের সামলাতে হবে, যাতে কেউ ঠকাতে না-পারে তার জন্য কী কী বিষয়ে হুঁশিয়ার থাকতে হবে তারও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
মুখোশ বিক্রির প্রধান স্ট্র্যাটেজি হল ক্রেতা-বিক্রেতার সরাসরি যোগাযোগ ঘটানো। দেশবিদেশের সম্ভাব্য ক্রেতাদের সোজা শিল্পীদের গ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, মুখোশ তৈরি দেখানো হচ্ছে। মুখামেলাও সে প্রচেষ্টারই অঙ্গ। কুশমন্ডিতে ‘ক্রাফট হাব’ তৈরি করে ‘হোম স্টে’ জনপ্রিয় করার প্রক্রিয়া চলছে। মুখোশ শিল্পীদের বাড়িতে বা মহিষবাথান হস্তশিল্প সমবায় সমিতি-র বাড়িতে কয়েক দিন কাটিয়ে আসতে পারেন পর্যটকেরা। ছিমছাম ব্যবস্থা। ঘুরে বেড়ানোর জন্য বাইসাইকেল ভাড়া দেওয়া হবে। ফল মিলছে। বিক্রি বেড়েছে। দেশবিদেশের নানা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ডাক আসছে। আয় বেড়েছে। কোনও শিল্পী কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় যাননি, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন, বাড়ি পাকা করছেন, বাড়িতে শৌচাগার বানাচ্ছেন, কথাবার্তা-ভাবনাচিন্তায় অনেক আধুনিক, চৌখশ হয়েছেন।
কিন্তু এখনও কাজ অনেক বাকি। কুশমন্ডি এবং তার মুখোশ অনেকের কাছেই এখনও অপরিচিত। যে জনপ্রিয়তা পিংলার পট, বাকনা বা দরিয়াপুরের ডোকরা, শান্তিনিকেতনের বাটিক কিংবা কাঁথা বা বাঁকুড়ার মাটির জিনিসের আছে তা কাঠের মুখোশের নেই। আরও প্রচার দরকার। দক্ষিণ দিনাজপুরের কিছু দর্শনীয় স্থানের উন্নয়ন করে বিজ্ঞাপন দিয়ে পর্যটক টানতে হবে, সেখানে মুখোশ বিক্রির স্টল থাকবে। বিশেষ করে শীতকালে প্রতিবছর বড় মেলা বসাতে হবে। সরকারের সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে এনজিওদেরও। ডাকিিন, নররাক্ষস, ভদ্রাকালীদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে উত্তরবাংলার এই অখ্যাত প্রান্তকে দুনিয়ার শিল্প-মানচিত্রে আলাদা জায়গা করে দেওয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy