ছবি: সংগৃহীত।
কোনও সঙ্কটেই সমাধানের পথ হিসেবে কখনও যুদ্ধের কথা ভাবতে নেই। যুদ্ধ কখনই কাম্য নয়। সমস্যা যত গভীরই হোক, যুদ্ধ এড়িয়ে গিয়ে সমাধানে পৌঁছনোর একটা না একটা পথ থাকেই।
আধুনিক সভ্যতার মূল্যবোধ এ কথাই বলে। তবু যদি যুদ্ধ করতেই হয়, তা হলে এসপার বা ওসপারের লক্ষ্য নিয়েই যুদ্ধ করা শ্রেয়। ছায়াযুদ্ধে কোনও সমস্যার সমাধান নেই। ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করেও কোনও লাভ নেই।
পাকিস্তান সম্ভবত এই সত্যকে এখনও উপলব্ধি করতে পারেনি। তাই তিন দশক ধরে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে আসছে ভারতের সঙ্গে। আরও অনেক বেশি সময় ধরে এক ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি। সে ছায়া তার নিজেরই।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
সম্প্রতি পাকিস্তান সফররত ভারতীয়দের প্রতি ইসলামাবাদ ‘ব্যাখ্যার অতীত অসৌজন্য’ দেখিয়েছে। শিখ তীর্থযাত্রীরা ভারত থেকে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। সফরকালে তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাকিস্তানের ভারতীয় হাইকমিশন। তীর্থযাত্রীদের তরফেও হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু আশাতীত অসৌজন্য দেখিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনের কর্তাদের সঙ্গে পাকিস্তান সফররত ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের সাক্ষাতের কর্মসূচি বার বার আটকে দিয়েছে ইসলামাবাদ।
বিস্মিত ভারতীয় হাইকমিশন। বিস্মিত ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। অত্যন্ত বিস্মিত তীর্থযাত্রীরাও। নয়াদিল্লি কঠোর শব্দে ইসলামাবাদের এই আচরণের নিন্দা করেছে। কিন্তু ছায়াযোদ্ধা পাকিস্তান এবং নিজের ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধরত পাকিস্তান অবিচলিত। ভবিষ্যতে এমন কিছু আর ঘটবে না, এমন আশ্বাস ইসলামাবাদ মোটেই দিচ্ছে না।
আরও পড়ুন
শিখ তীর্থযাত্রী: পাকিস্তানের আচরণের কড়া প্রতিবাদ বিদেশমন্ত্রকের
দুই প্রতিবেশীর মধ্যে কূটনৈতিক তিক্ততা সম্প্রতি চরমে পৌঁছেছিল। পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে কূটনীতিকদের হেনস্থা করার অভিযোগ তুলছিল। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের তরফে পরে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, সমস্যা মিটে গিয়েছে। কিন্তু ইঙ্গিতের কিছু দিনের মধ্যেই ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে পাক কর্তৃপক্ষের আচরণ আবার বলে দিল, ভারত পাকিস্তানের কূটনৈতিক টানাপড়েন সহজে মেটার নয়। পাকিস্তানের এ হেন আচরণের কারণ কিন্তু ওই ছায়াযুদ্ধ এবং ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ।
আশির দশকের শেষ ভাগ থেকে সন্ত্রাসকে নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে পাকিস্তান। সরাসরি যুদ্ধ না করেও ভারতের বিরুদ্ধে অবিরত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নীতি নিয়েছে পাকিস্তান। সন্ত্রাসবাদীদের ব্যবহার করে ভারতে নাশকতা চালানো, আন্তর্জাতিক সীমান্তে এবং নিয়ন্ত্রণরেখায় বছরভর উত্তেজনা বহাল রাখা, ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর উপর বার বার লুকিয়ে-চুরিয়ে আঘাত হানা, কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদে নিরন্তর অক্সিজেন জোগানো— এই সব নীতির মাধ্যমেই ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে আসছে পাকিস্তান। ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯— পর পর তিনটি যুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় হয়েছে পাকিস্তানের। তাই ঘোষিত যুদ্ধে যাওয়ার সক্ষমতা পাকিস্তানের কমই। ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে পরাজয়ের গ্লানি মেটানোর চেষ্টা চালিয়ে যায় ইসলামাবাদ।
আগেই বলেছি, পাকিস্তানের আর এক যুদ্ধ নিজের ছায়ার সঙ্গেই। ছায়াটা পূর্বতন পাকিস্তানের। যে পাকিস্তানকে তার নেতারা ‘এশীয় বাঘ’ নামে অভিহিত করতেন। আর আসল অস্তিত্ব বর্তমানের হীনবল, ব্যর্থ, বহুলাংশে অরাজক পাকিস্তানের। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল যে পাকিস্তান, আচমকা আক্রমণে জম্মু-কাশ্মীরের একাংশ দখল করে নিয়েছিল যে পাকিস্তান, আমেরিকা-সহ পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলির কাছ থেকে নিরন্তর মোটা আর্থিক সাহায্য পাচ্ছিল যে পাকিস্তান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সঙ্গে নিজেদের শাসক আয়ুব খানের সখ্যের ফোটোগ্রাফ তুলে ধরে নিজেদের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব জাহির করতে অভ্যস্ত ছিল যে পাকিস্তান, সেই পাকিস্তানই নিজেকে ‘এশীয় বাঘ’ বলে দাবি করত। ভ্রম ভাঙতে সময় লেগেছিল আঠারো বছর। ১৯৬৫-র যুদ্ধে ভারতের হাতে পরাজয় তথাকথিত এশীয় বাঘের আত্মবিশ্বাস চূর্ণ করে দিয়েছিল। তার ঠিক ছ’বছর পরে ১৯৭১ সালে দু’টুকরো হয়ে যাওয়ার পরে নিজেকে ‘এশীয় বাঘ’ বলতে ভুলেই গিয়েছে পাকিস্তান।
তথাকথিত এশীয় বাঘটা আর নেই, কিন্তু তার ছায়া রয়ে গিয়েছে। সেই ছায়া পাকিস্তানকে প্ররোচিত করে ভারতের দিকে নিরন্তর চ্যালেঞ্জ ছুড়তে। কিন্তু বর্তমানের পাকিস্তান সেই চ্যালেঞ্জ ছোড়ার মতো পরিস্থিতিতে নেই। সন্ত্রাসের মদতদাতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়া পাকিস্তান আন্তর্জাতিক পরিসরে কোণঠাসা। গণতন্ত্র অত্যন্ত দুর্বল পাকিস্তানে। দীর্ঘ অপশাসনে এবং রাজনৈতিক টালমাটালে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক ভাবে চূড়ান্ত ব্যর্থ পাকিস্তান। এই পাকিস্তান নিজের দুর্বলতাগুলোকে কাটিয়ে উঠতে চায়। কিন্তু এই পাকিস্তানকে সারা ক্ষণ লড়তে হয় সেই ‘এশীয় বাঘ’ নামক পাকিস্তানের ছায়ার বিরুদ্ধে, যে ছায়া ভারত বিরোধিতাকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে।
নিজের ছায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যদি কোনও দিন জিততে পারে পাকিস্তান, ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালানোর প্রয়োজন আর পড়বে না সে দিন। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তিক্ততার অবসান প্রায় অসম্ভব। পাকিস্তানের আচরণেই বার বার তা প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy