—প্রতীকী ছবি।
একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের প্রধানতম দায়বদ্ধতা কার প্রতি, তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। প্রতিটি প্রশ্নেই প্রথমে জানানো হয়েছে যে, দল কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কী করবে; এবং তার পরে জানিয়েছে যে, গোটা দেশের জন্য কী করবে। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে, এই আঞ্চলিকতা কি সর্বভারতীয় ঐক্যের ধারণার পক্ষে ক্ষতিকারক নয়? আদর্শ পরিস্থিতিতে দেশ পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলগুলির কর্তব্য নিজেদের অন্য সব পরিচিতি বিস্মৃত হওয়া; দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য যা সর্বাধিক প্রয়োজন, শুধুমাত্র সেই কাজে ব্রতী হওয়া। এই অবস্থানের নিদর্শন হিসাবে একটি সুপ্রাচীন উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে— পশ্চিমবঙ্গের বিপুল স্বার্থহানি ঘটবে জেনেও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় রেলপথে পণ্য পরিবহণের মাসুল সমীকরণের নীতি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু, এই উদাহরণটিই বলে দেয় যে, শেষ অবধি পশ্চিমবঙ্গের সেই ক্ষতি পূরণ করার মতো কোনও ব্যবস্থা কেন্দ্রের তরফে হয়নি। এবং, পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রে যে দলেরই শাসক থাকুক না কেন, উন্নয়নের গতি দেশময় সুষম হয়নি— যিনি যে রাজ্য থেকে নির্বাচিত, কেন্দ্রীয় শাসক হিসাবেও তিনি সেই রাজ্যেরই স্বার্থসিদ্ধি করেছেন। তার সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ রেল মন্ত্রক— যে সময়ে যে রাজ্যের জনপ্রতিনিধি রেলমন্ত্রী হয়েছেন, সে সময় সেই রাজ্যে রেলের বিপুল বিনিয়োগ ঘটেছে। অতএব, পশ্চিমবঙ্গের দল তৃণমূল কংগ্রেস যদি বাংলার উন্নয়নের প্রশ্নটিকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে চায়, তাতে নৈতিক বা রাজনৈতিক আপত্তি করা মুশকিল।
বস্তুত, এই দফায় কেন্দ্রে যদি অ-বিজেপি সরকার গঠিত হয়, তবে এক রকম নিশ্চিত ভাবেই বলা চলে যে, তাতে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের গুরুত্ব হবে বিপুল। এমনকি কংগ্রেসের মতো ‘সর্বভারতীয়’ দলও এখন কার্যত কয়েকটি অঞ্চলেরই প্রতিনিধিত্ব করে মাত্র। অতএব, যুক্তরাষ্ট্রীয়তার একটি নতুন পর্ব উন্মোচিত হতে পারে, এমন সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তাহারে সেই ইঙ্গিত রয়েছে— কেন্দ্র একা সিদ্ধান্ত নেবে না, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হবে। একটি দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কী ক্ষতি করতে পারে, গত দশ বছরে ভারত তার বহুবিধ উদাহরণ প্রত্যক্ষ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ধারণাটিকে প্রকৃতার্থে ফিরিয়ে আনার সময় এসেছে।
অস্বীকার করা চলে না যে, তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তাহারে প্রভাব পড়েছে বিজেপির— ‘মোদী কি গ্যারান্টি’-র পাল্টা হিসাবে উঠে এসেছে ‘দিদির শপথ’। যেখানে এই ইস্তাহারের সম্পূর্ণ পৃথক হওয়ার কথা ছিল, সেটি উন্নয়নের বিকল্প নীতির রূপরেখা। গত দেড় দশকে পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে যত শোরগোল হয়েছে, তাতে অনেকাংশেই ঢাকা পড়ে গিয়েছে এই কথাটি যে, প্রত্যক্ষ ভাবে নাগরিকের সঙ্গে সরকারের সংযোগের মাধ্যমে একটি বিকল্প উন্নয়ন মডেল এই রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাতে যেমন কন্যাশ্রী আছে, লক্ষ্মীর ভান্ডার আছে, তেমনই আছে দুয়ারে সরকারের মতো কর্মসূচি। পশ্চিমবঙ্গের এই মডেলের প্রধানতম সমস্যা এ রাজ্যের শিল্পহীনতা— যথেষ্ট টাকার সংস্থান না থাকলে দীর্ঘমেয়াদে এই মডেল বজায় রাখা মুশকিল। কিন্তু, সর্বভারতীয় স্তরে সেই সমস্যা তুলনায় কম। তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তাহারে এই বিকল্প মডেলের বিভিন্ন অংশকে সর্বভারতীয় স্তরে চালু করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু, সামগ্রিক ভাবে প্রত্যক্ষ নগদ বা সুবিধা হস্তান্তরের এই মডেলটির কথা আরও অনেক জোর দিয়ে বলা যেত। নিজেদের রাজনীতির এই দিকটি সম্বন্ধে তাঁরা কি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নন? সাঙাততন্ত্র-পরিচালিত অর্থব্যবস্থার দিক পরিবর্তন করতে এমন একটি মডেলের গুরুত্ব সম্বন্ধে তাঁদের কি সংশয় আছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy