যার যা খুশি বলবে, যে যা চায় লিখবে— এরই নাম বাক্স্বাধীনতা। এই আপাত-সরল আদর্শের যুক্তি দিয়েই মার্ক জ়াকারবার্গের মেটা নামক সংস্থাটি তাদের সমাজমাধ্যমের পরিসরগুলিতে বিনিয়ন্ত্রণের নতুন নীতি প্রবর্তন করেছে। এই সংস্থার মালিকানাধীন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সমাজমাধ্যমে নাগরিকরা যা লেখেন বা তুলে দেন, সেগুলি ঠিক না ভুল, সত্য না মিথ্যা, সেই বিষয়ে তদারকি করা এবং যথাযথ না হলে প্রতিরোধ বা প্রত্যাহার করা অথবা সংস্থার তরফে সতর্কবাণী যোগ করা হয়। এই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাটি ষোলো আনা কার্যকর, এমন দাবি সংস্থার পরিচালকরাও কখনও করতে পারেননি— নজরদারির ফাঁক গলে বিস্তর মিথ্যা এবং বিপজ্জনক কথা ও ছবি সমাজমাধ্যমে অহরহ প্রচারিত ও পুনঃপ্রচারিত হয়ে থাকে। তবে এ-কথা অনস্বীকার্য যে, নিয়ন্ত্রণের একটি আয়োজন আছে এবং বহু ক্ষেত্রেই তা কিছু দূর অবধি কার্যকরও বটে। কিন্তু সংস্থার কর্তারা এখন বলছেন, এই আয়োজনটি অতিমাত্রায় শাসনাত্মক হয়ে উঠেছে, বাড়াবাড়ি রকমের নজরদারিতে উৎসাহ দিচ্ছে, এই বিকৃতি সংশোধন করা দরকার, ‘যে বাক্স্বাধীনতা আমাদের সংস্থার মূল আদর্শ, সেই শিকড়ে ফেরা দরকার।’ নতুন ব্যবস্থায় ভুল বা বিকৃতি সংশোধনের কাজটি তুলে দেওয়া হচ্ছে নাগরিকদের হাতেই। কোনও পোস্টে বিচ্যুতি দেখলে তাঁরাই সংশোধনী পোস্ট দেবেন, সত্য দিয়ে মিথ্যাকে প্রতিহত করবেন, প্রকৃত তথ্যের সম্মার্জনী দিয়ে তথ্যের ভেকধারী অপপ্রচারকে খারিজ করবেন— এটাই নববিধানের নীতিসূত্র।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, এ অতি চমৎকার বন্দোবস্ত। সত্যই তো, সমাজমাধ্যমের ভিত্তিমূলে আছে সকলের সমান এবং অবাধ মতপ্রকাশের অধিকার। সেই অধিকার দাবি করে, যে কোনও নাগরিক সেখানে যে কোনও কথা জানাতে পারবেন, যে কোনও সংবাদ দিতে পারবেন, যে কোনও মত প্রকাশ করতে পারবেন। বলা যেতে পারে, সমাজমাধ্যমের পরিসরগুলি মুক্ত বাজারের মতো। তথ্য তথা মতামত বিনিময়ের বাজার। সেই পরিসর যাঁরা নির্মাণ এবং পরিচালনা করেন তাঁরা বাজারটিকে যত বেশি মুক্ত ও অবাধ রাখতে পারবেন, ততই বাক্স্বাধীনতার আদর্শ সম্মানিত হবে। সেই পরিসরে সত্য এবং অসত্য সবই থাকতে পারে, শত পুষ্পের সঙ্গে সহস্র আগাছার আবির্ভাব হতে পারে, শেষ অবধি খোলা বাজারের প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই সত্যাসত্যবিনিশ্চয় হবে। অজ্ঞতা বা ভ্রান্তির বশেই হোক, অশুভ স্বার্থের কারণেই হোক, অনেকে সেখানে বিষ ছড়াতে পারেন, কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন দায়িত্বশীল নাগরিকদের দায়িত্ব সেই বিষের প্রতিষেধক সরবরাহ করা। তাঁরা সেই দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করলে মিথ্যা এবং অপপ্রচার পরাস্ত হবে, সাময়িক সঙ্কট অতিক্রম করা যাবে। এই যুক্তি যত দূর যায় তত দূর তা অতি উৎকৃষ্ট বটে। কিন্তু শেষ অবধি তা কি যথেষ্ট দূর অবধি যায়? যেতে পারে?
বাস্তব অভিজ্ঞতা ভরসা দেয় না। এই শতাব্দীর প্রথম দশকে নবীন সমাজমাধ্যমের পরিসরে নাগরিকের অবাধ এবং সমান ভূমিকার ধারণাটি অনেক দূর অবধি সত্য ছিল। কিন্তু তার পরে, বিশেষত গত কয়েক বছরে সমাজমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীভূত হয়েছে অতিকায় মুষ্টিমেয় সংস্থা তথা পরিচালকের হাতে। সেই নিয়ন্ত্রণ তথ্যপ্রযুক্তির জটিল এবং দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে নাগরিকদের কথোপকথনকে প্রবল ভাবে প্রভাবিত করে, আপাত-স্বাধীন মতপ্রকাশের অন্তরালে থাকে মতামত, ধারণা এবং বিশ্বাস ‘উৎপাদন’-এর বিস্ময়কর কৌশল। সমাজমাধ্যমের চালকরা যে এমনকি বিভিন্ন দেশের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা ধরেন, তার সঙ্কেত মিলেছে বারংবার। আবার, রাষ্ট্রশক্তির অধীশ্বররাও তাঁদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। বস্তুত, মেটা-র সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি ঘোষিত হয়েছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরাগমনের মাত্র কয়েক দিন আগে। লক্ষণীয়, ট্রাম্প সমাজমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখার ঘোর বিরোধী। এবং লক্ষণীয়, তাঁর পরম সুহৃৎ ইলন মাস্কের মালিকানাধীন সমাজমাধ্যম পরিসর এক্স-এ আগেই নজরদারির ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হয়েছে, সংশোধনের দায়দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে নাগরিকের উপরেই। সঙ্কেতগুলি স্পষ্ট এবং উদ্বেগজনক। এক দিকে মহাশক্তিধর সংস্থার পরিচালক এবং তাঁদের সঙ্গী রাষ্ট্র, অন্য দিকে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত নাগরিক সমাজ— সমাজমাধ্যমের ‘খোলা বাজার’-এ কার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, অনুমান করা কঠিন নয়। এমন পরিসরে ক্ষমতাবানেরা বিষবাষ্প সঞ্চার করলে কেবল নাগরিক উদ্যোগে তাকে দূর করার ভরসা দেয় কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy