পরিসংখ্যানের ছলনা নিয়ে রঙ্গরসিকতা বা সমালোচনা বিস্তর। কিন্তু দোষ পরিসংখ্যানের নয়, তার অপব্যবহারের। যথাযথ ভাবে ব্যবহার করলে সে অল্প কথায় গুরুত্বপূর্ণ সত্যের স্বরূপ উন্মোচন করতে পারে। তার একটি দৃষ্টান্ত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফাইনান্স অ্যান্ড পলিসি বা এনআইপিএফপি-র দুই গবেষকের এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা। তাঁদের গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে ‘সামাজিক খরচ ও আর্থিক নীতি’ শীর্ষক এক রিপোর্টে। তার প্রধান বক্তব্য: গত তিন দশকে ভারতে জাতীয় আয় তথা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারি খরচে বিশেষ কোনও অগ্রগতি ঘটেনি— ১৯৯০-৯১ সালে সামাজিক উন্নয়নে সরকারি ব্যয়ের মাত্রা ছিল জিডিপির ৫.৮ শতাংশ, ২০১৯-২০ সালে তা পৌঁছেছে ৬.৮ শতাংশে। তার মধ্যে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়ের অনুপাত ছিল জিডিপির ০.৯২ শতাংশ, সামান্য বেড়ে হয়েছে ১.৩৬ শতাংশ। শিক্ষায় অনুপাত ২.৯৭ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২.৮৮ শতাংশ। শিক্ষায় জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ এবং স্বাস্থ্যে ৩ বা অন্তত ২.৫ শতাংশ অনুপাতে সরকারি ব্যয়ের দাবি বহু পুরনো। দলনির্বিশেষে সমস্ত সরকারই মুখে এই দাবি মেনে নেয়, এমনকি নরেন্দ্র মোদী সরকারও। কিন্তু কাজে? মানব উন্নয়নে সরকারি বিনিয়োগের পরিসংখ্যান যে তিমিরে, সেই তিমিরেই।
‘বিনিয়োগ’ শব্দটি কথার কথা নয়। শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দকে সচরাচর বিনিয়োগ হিসাবে দেখা হয় না, দেখা হয় নিছক জনকল্যাণের খরচ হিসাবে। সেই ধারণা ভুল নয়, কিন্তু অসম্পূর্ণ। বিনিয়োগ হিসাবেও এই ধরনের বরাদ্দ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগ বললে সচরাচর যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, পরিকাঠামো ইত্যাদি নির্মাণের কথা বোঝায়। অথচ দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ভিত্তি হিসাবে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো সম্পদ যে সম্পূর্ণ অপরিহার্য, দুনিয়া জুড়ে সেই সত্য অভ্রান্ত ভাবে প্রমাণিত। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে নানা প্রশ্নে বিস্তর মতানৈক্য থাকলেও এই বিষয়ে তাঁরা সকলেই একমত যে, শিক্ষায় এবং স্বাস্থ্যে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করা হলে ও সেই সম্পদ যথাযথ ভাবে ব্যবহার করা হলে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধিতে ও বৃহত্তর মানব উন্নয়নে তার বিরাট সুফল পাওয়া যায়। দেশের নীতিকাররা যদি এই সত্যটিকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতেন, তা হলে জিডিপির বৃদ্ধি-হার বাড়ানোর প্রকরণ হিসাবেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ত।
এনআইপিএফপি রিপোর্টে উল্লিখিত একটি তথ্য এই প্রসঙ্গে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতে সরকারি ব্যয় দেশের জিডিপির প্রায় ২৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে এই হার রীতিমতো কম। মানব উন্নয়নে এগিয়ে থাকা অনেক দেশেই এই অনুপাত ৪০ শতাংশ বা তার বেশি। অর্থাৎ, অনেক দেশের তুলনাতেই ভারতে সরকার কম খরচ করে। এ দেশে দীর্ঘদিন ধরে সরকার নানা অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিল, তার জন্য প্রচুর খরচ হত, বিশেষত বিভিন্ন খাতে বিপুল ভর্তুকি গুনতে হত। নব্বইয়ের দশক থেকে আর্থিক সংস্কারের ফলে এই সব খরচ সঙ্গত কারণেই কমেছে। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নের সামাজিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যে ব্যয়বৃদ্ধির যে প্রয়োজন ছিল, তা পূরণ করা হয়নি। তার একটি বড় কারণ অর্থনীতি বিষয়ে অস্বচ্ছ ধারণা। এই অস্বচ্ছতা বর্তমান শাসকদের মধ্যে অতিমাত্রায় প্রকট। প্রয়োজনীয় সরকারি বিনিয়োগ বাড়ালে প্রাথমিক ভাবে ঘাটতি কিছুটা বাড়লেও যে কোনও ক্ষতি নেই, আয়বৃদ্ধি থেকেই সেই বিনিয়োগের সংস্থান হবে— এই প্রাথমিক বোধটি যদি তাঁদের থাকত, তা হলে অবিলম্বে সামাজিক ব্যয়ের ঘাটতি মেটাতে তৎপর হতেন। আসন্ন বাজেটেই তার প্রতিফলন দেখা যেত। কিন্তু সীমিত বোধবুদ্ধি এবং অসীম অহমিকার এই স্বর্ণযুগে তেমন কোনও আশা করাই বাতুলতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy