প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
শাসনের দশম বছরে পদার্পণ করলেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে তাঁর বয়ানের সিংহভাগ জুড়ে ছিল অর্থনীতির কথা। অতএব, তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে হিসাব নেওয়াই যায় যে, তাঁর আমলে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার কতখানি উন্নতি হল। অস্বীকার করা যাবে না যে, তাঁর দ্বিতীয় দফার অন্তত দু’টি বছর নিমজ্জিত হয়েছে অতিমারির গর্ভে। গোটা দুনিয়ার অর্থব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছিল, ভারতও স্বভাবতই ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু, খেয়াল করা ভাল যে, দুনিয়ার বৃহৎ অর্থব্যবস্থাগুলির মধ্যে ভারতের আয়বৃদ্ধির গায়ে অতিমারির ধাক্কা লেগেছিল সবচেয়ে বেশি। এর আগের আর্থিক মন্দা, অর্থাৎ ২০০৮ সালে, ছবিটা ছিল ঠিক উল্টো— বৃহৎ অর্থব্যবস্থাগুলির মধ্যে ভারতের অবস্থাই ছিল সবচেয়ে ভাল। ছবিটি পাল্টে যাওয়ার কারণ বৈশ্বিক মন্দায় নেই, রয়েছে অর্থব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্যে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে নোট বাতিল, এবং ২০১৭-র জুলাইয়ে জিএসটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার গায়ে— বিশেষত দেশের নগদনির্ভর অসংগঠিত ক্ষেত্রের গায়ে— যে আঘাত লেগেছিল, তা বাইরের ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা বহুলাংশে নষ্ট করে দেয়। হিসাব বলছে, অতিমারি আরম্ভ হওয়ার আগের চার বছরের প্রতি বছর দেশে আর্থিক বৃদ্ধির হার তার আগের বছরের তুলনায় কম থেকেছে। গ্রামাঞ্চলে প্রকৃত ভোগব্যয় কমেছিল অতিমারি আরম্ভ হওয়ার আগেই; বাজারে চাহিদার অভাবও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। স্পষ্টতই, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা বর্তমানে যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার জন্য অতিমারিকে সম্পূর্ণত দায়ী করা চলে না— অর্থব্যবস্থার পরিচালকদের দায়ও অনেক।
জনস্মৃতি সচরাচর দুর্বল, তবুও কারও খেয়াল থাকতে পারে যে, এলপিজি সিলিন্ডারের দাম চারশো টাকা ছাড়ানোয় দেশজোড়া বিক্ষোভ আন্দোলন করেছিল বিজেপি। গত ন’বছরে এক সিলিন্ডার গ্যাসের দাম এগারোশো টাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছে। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিও সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলেছে। আবারও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দিকে আঙুল তোলা যেতে পারে— অতিমারি, এবং তার জের মিলিয়ে না যেতেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ আন্তর্জাতিক পণ্য সরবরাহের বাজারকে বিপর্যস্ত করেছে, ডলার মহার্ঘ হওয়ায় দাম বেড়েছে আমদানিরও। অর্থনীতিবিদ মাত্রেই স্বীকার করেন, মূল্যস্ফীতির উপরে নীতিনির্ধারকদের নিয়ন্ত্রণ তুলনায় অনেক কম। কিন্তু, একই সঙ্গে মনে রাখা ভাল যে, গত এক বছরে তেল আমদানির ক্ষেত্রে ভারত ক্রমেই রাশিয়া-মুখী হয়েছে, কারণ সেই তেল পাওয়া গিয়েছে তুলনায় সস্তায়। পশ্চিম এশিয়ার তেলের দামও কমেছে। গত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতির সমস্যা খানিক নিয়ন্ত্রণে এসেছে বটে, কিন্তু যা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, তা হল, ২০১৪-পূর্ব সময়ে নরেন্দ্র মোদী যা-ই বলুন না কেন, মূল্যস্ফীতির হারকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাঁরও নেই। অন্য দিকে, প্রতিশ্রুতি ছিল, বছরে এক কোটি নতুন কর্মসংস্থান হবে। পরিবর্তে, বেকারত্বের হার ভারতে নতুন রেকর্ড স্থাপন করল।
বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় ভারত কল্যাণরাষ্ট্রের মূলগত দর্শন থেকে ক্রমেই বিচ্যুত হয়েছে, কিন্তু বাজার অর্থনীতির সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেনি। জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনাকে প্রধানমন্ত্রী ‘কংগ্রেস জমানার ব্যর্থতার প্রতীক’ বলেছিলেন। অতিমারি তাঁকে সেই যোজনার উপরে নির্ভর করতে বাধ্য করেছে ঠিকই, কিন্তু সরকারি উদাসীনতায় প্রকল্পটি রক্তহীন হয়েছে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারি পরিকাঠামোর উন্নতির পরিবর্তে জোর দেওয়া হয়েছে বিমার উপরে। একাধিক সমীক্ষার ফল বলছে যে, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্য দিকে, বিলগ্নিকরণের উদ্যোগ গতি হারিয়েছে, কতিপয় শিল্পগোষ্ঠীর আয়ত্তে এসেছে অধিকতর রাষ্ট্রীয় সম্পদ। ন’বছর আগে যে প্রতিশ্রুতি দেশবাসীকে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী, তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে তা বহুলাংশে অধরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy