প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে’— ক্ষেত্র ও কার্যবিশেষে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করা ভারতের প্রধানমন্ত্রী রবীন্দ্রগানের এই চরণটি জানেন কি না, আমাদের জানা নেই। তবে তাঁর ‘আপন কাজে’ কাজ ও তার পরিপ্রেক্ষিত ছাপিয়ে যে অখণ্ড ‘তিনি’ই আগাগোড়া বিরাজিত, এ বিলক্ষণ জানা। উদাহরণ মিলবে ভূরি ভূরি— ইদানীং কালে ‘প্রোজেক্ট চিতা’ যেমন। গত বছর সেপ্টেম্বরে নামিবিয়া থেকে আটটি চিতা উড়িয়ে আনা হয়েছিল ভারত সরকারের পরিকল্পনা মাফিক, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আরও বারোটি— মধ্যপ্রদেশের কুনো জাতীয় উদ্যানে তাদের ছাড়া হয়েছে। এ বছর মার্চের শেষে একটি চিতার চারটি ছানা হয়েছে, এও সুসংবাদ: বিশেষত ভারতে যে প্রজাতির শেষ প্রাণীটি স্বাধীনতার বছরে স্থানীয় রাজার হাতে শিকার হয়ে ‘অতীত’, ১৯৫২ সালে যাকে এ দেশে ‘বিলুপ্ত’ ঘোষণা করা হয়েছিল, রীতিমতো ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করে, নামিবিয়ার সঙ্গে ‘এমওইউ’ স্বাক্ষর করে, দেশের বিজ্ঞানী পরিবেশবিদ ও চিতা-বিশারদদের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে ভারতে তার বিজ্ঞানসম্মত স্থানান্তর ও সফল বংশবৃদ্ধি— প্রশংসার বইকি!
কিন্তু পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ভারসাম্য, ইকো-টুরিজ়্ম, কর্মসংস্থানের সূত্রে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা— ভারতে চিতার ‘আগমন’কে আসলে যে আঙ্গিকগুলি থেকে সম্যক তুলে ধরা উচিত ছিল, তা হল কই! প্রোজেক্ট চিতা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে বহু প্রকার, কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর কথায়, চিতা নিয়ে তাঁর মন্তব্য-টুইটে এ সমস্ত সমস্যা ছাপিয়ে আত্মগর্বের ছায়াটিই ধরা পড়ছে বেশি। এই গর্ব যত না চিতা-কেন্দ্রিক বা পরিবেশগত, তারও বেশি রাজনৈতিক। গত সাত দশকে কোনও সরকার ভারতে চিতা নিয়ে আসতে পারেনি, ‘আজ়াদির অমৃত মহোৎসব’-এ নরেন্দ্র মোদী সরকারই এই কাজ করল, দেশে এখন ‘অমৃত কাল’ চলছে এবং তারই অঙ্গ ভারতে এই চিতা নিয়ে আসা— এই জাতীয় মন্তব্য-বিবৃতি-টুইট ইত্যাদি আসলে বোঝায়, চিতা উপলক্ষ মাত্র, আসল কথাটি দেখনদারি। আরও যা দুর্ভাগ্যের, প্রধানমন্ত্রীর সহকর্মী ও অধীনরা এই দেখনদারিকে দৃষ্টিকটু ব্যক্তিপূজার উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন: নইলে কেনই বা প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনকেই চিতাদের খাঁচামুক্ত করার দিবস হিসাবে বেছে নেওয়া হবে, কেনই বা কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রীকে ফলাও করে বলতে হবে ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে’ চিতার ভারত-আগমন কথা!
ওড়িশায় ভয়ঙ্কর রেল-দুর্ঘটনার পরে সমাজমাধ্যমে বহু ক্ষুব্ধ মানুষ বলেছিলেন, অপ্রীতিকর কিছু ঘটলে সেই ‘অপরাধ’ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর, অন্য দিকে দ্রুতগতি বা অত্যাধুনিক পরিষেবার ‘কৃতিত্ব’ পুরোটাই প্রধানমন্ত্রীর, এই ‘অবিচার’ শেষ হোক। দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি, এটিই আজকের ভারতে বাস্তবচিত্র। ‘বন্দে ভারত’ ট্রেন কিংবা চিতা, রেকর্ড উচ্চতার মূর্তি, চোখ-ধাঁধানো দেবমন্দির বা নবনির্মিত সংসদ ভবন— সবই এই দেশ পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণে, তাঁর দক্ষতা ও দূরদৃষ্টির ফলস্বরূপ, কেন্দ্রীয় সরকার এ ভাবেই আজকাল সব প্রচার করছে। প্রধানমন্ত্রীরও তাতে কোনও না নেই। এক দেশ এক জাতি এক দল এক নির্বাচনের জিগির তোলার সঙ্গে এক নেতা এক মুখের এই ছকটি বিলক্ষণ খাপ খায়। বস্তুত এই ‘এক’-এর আত্ম বা সমষ্টিভজনাই লক্ষ্য, চিতা বা আর সব কিছুই নিমিত্তমাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy