‘অপরিচিত’ ছবির দৃশ্যে অনির্বাণ, ঋত্বিক ও কমলেশ্বর। ছবি: সংগৃহীত।
মানুষ চেনা বড় মুশকিল। কখনও কখনও কাছের মানুষকে বুঝতেই কত সময় লেগে যায়! আবার কোনও কোনও সময় দূরের মানুষকেই মনে হয় কত আপন। এখন যাকে চেনেন বলে মনে করেন, বা বিশ্বাস করেন অবলীলায়, সে অদূর ভবিষ্যতে কত টুকু আপনার বিশ্বাসের মান রাখবে তা ভেবে দেখেছেন? প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই যদি গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসেন, তাহলে কাউকে বিশ্বাস করেই উঠতে পারবেন না সারা জীবন। সেটাও তো খুব একটা সুস্থ ভাবনা নয়!
তাই মানুষ ঠকে। আর এক মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকে যায়। ভালবেসে হেরে যায়। আর কপাল খারাপ হলে ষড়যন্ত্রের শিকারও হয় বইকি! রঞ্জন ঘোষাল (ঋত্বিক চক্রবর্তী) একটি লাইব্রেরি চালায়। এক দিন গভীর রাতে, রাস্তার ধারে তাকে আহত অবস্থায় খুঁজে পায় লন্ডনের কয়েক জন পুলিশ। হাসপাতালে রঞ্জনকে ভর্তি করার পর জানা যায়, মাথার পিছনে খুব ভারী কিছু দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়েছে। আঘাত এমনই সে প্রাণও হারাতে পারত। বেঁচে গেলেও, জ্ঞান ফেরার পর বোঝা যায়, আগের প্রায় কোনও কথাই আর মনে করতে পারছে না সে। মাথায় জোরে চোট লাগার ফলে সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে রঞ্জনের। নিজের বাড়ি কোথায় মনে করতে পারে না সে, স্ত্রী রিয়াকেও চিনতে পারে না আর।
আপাত দৃষ্টিতে ছাপোষা, ভদ্র, ভালমানুষকে কে এইভাবে খুন করার চেষ্টা করল, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব পড়ে পুলিশ আধিকারিক অভীক দত্তের (অনির্বাণ চক্রবর্তী) উপর। পরিচালক জয়দীপ মুখোপাধ্যায় তাঁর ছবির গল্পে ‘মেমোরি লস’ ও ‘সাইকোলজিকাল ড্রামা’ মিশিয়ে দর্শকের কাছে পরিবেশন করার চেষ্টা করেছেন। পদ্মনাভ দাশগুপ্তের চিত্রনাট্য বেশ খানিকটা সময় নিয়েছে চরিত্রগুলো স্থাপন করতে। তার ফলে ছবির প্রথমার্ধের গতি বেশ মন্থর। এর সঙ্গে চিত্রগ্রহণে ধূসর আর অন্ধকার রঙের ক্যানভাস দর্শকের চোখে খানিক ক্লান্তিকরও লাগতে পারে।
দ্বিতীয়ার্ধে এসে অবশ্য এই ছবি বেশ গতি পেয়েছে। এমনকি, পরিচালক গল্পের শেষে একটা ‘টুইস্ট’ রাখারও চেষ্টা করেছেন, যা হয়তো অনেক দর্শক আগে থেকে আন্দাজও করে ফেলতে পারেন। গল্পের গতি নিজের সুবিধা মতো বেড়েছে, কমেছে। ফলে গল্প ও চিত্রনাট্যে বেশ কিছু ফাঁকফোকর থেকে যায়।
রহস্যর নিরিখে এই ছবি মধ্যমানের কারণ রহস্যের ছবি দেখতে দেখতে তার ফাঁকগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করলে সেই রহস্যের ছবি দেখার মজাটাই মাটি। গল্পের বেশ কিছু দিক মনে প্রশ্ন তৈরি করে। এমন একটা সময়ে আমরা বাস করি, যেখানে সমাজমাধ্যমের বাড়াবাড়ি। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একটা মানুষের পরিচয় নিয়ে কি এত সন্দেহ আর ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা সম্ভব?
ঋত্বিক চক্রবর্তী রঞ্জন ঘোষালের চরিত্রে খুবই বিশ্বাসযোগ্য। এক জন মানুষ যে জ্ঞান ফিরে নিজেকেই চিনতে পারছে না ঠিক করে, তার ঠিক যতটা অসহায় লাগা উচিত, যতটা ভয় পাওয়া উচিত, আশপাশের সকলকে সন্দেহ করা উচিত— সবটাই তাঁর অভিনয়ে যথাযথ ফুটে উঠেছে। অদিতির চরিত্রে ইশা সাহার অভিনয়ে কোথাও এতটুকু বাড়তি অভিনয় নেই। সবটাই মাপা। চিত্রনাট্য জোরালো হলে, তাঁর উপস্থিতি আরও একটু জোরালো হতে পারত। অরণ্যের চরিত্রে সাহেব ভট্টাচার্যকে আরও একটু সময় সংলাপ দেওয়া যেত না কি? চিত্রনাট্য লেখার সময় অরণ্যের চরিত্রকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলেই মনে হয়েছে। ছোট্ট একটি চরিত্রে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ভাল।
এখন অনেক বাংলা ছবি আর সিরিজেই অনির্বাণ চক্রবর্তী তুরুপের তাসের মত আবির্ভূত হচ্ছেন। এখানেও পুলিশ অফিসার অভীক দত্তের চরিত্রে তিনি। পরিচালক অবশ্য তাঁকে নিয়ে আগেও কাজ করেছেন। অনির্বাণ অভিনীত জনপ্রিয় চরিত্র ‘একেন বাবু’কে দু’বার বড় পর্দায় নিয়ে এসেছেন জয়দীপ নিজেই। তাই পরিচালকের সঙ্গে তাঁর রসায়নও খাসা। এই ছবিতেও তাঁর অভিনয় বেশ ভাল। তবে বারবার রহস্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব (সে গোয়েন্দা হয়েই হোক, বা পুলিশ আধিকারিক হয়েই হোক) তাঁর কাঁধে পড়লে একঘেয়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনি ভাল অভিনেতা। তাঁকে নানা রকম চরিত্রের মোড়কে পরিচালকেরা সামনে আনবেন, এটাই স্বাভাবিক।
দু’ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ের ছবি ‘অপরিচিত’র গল্পের ভীত তাই জোরালো হলেও, যথেষ্ট রহস্যের অভাবে খানিক ফিকেই থেকে যায়। একবার কাছের মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস টলে গেলে মানুষ যেমন নড়বড়ে হয়ে বাঁচে, ঠিক তেমন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy