অমিত শাহ। —ফাইল চিত্র।
শীত সমাগত, বসন্তও অদূরে। ভোট আসছে, বিভাজন ও বিদ্বেষও আবার জমিয়ে বসছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বার্তা প্রচার হচ্ছে অমিতবিক্রমে: নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) কার্যকর হবে কিছু দিনেই। গত চার বছরে দেশ জুড়ে ভয়ের আবহ তৈরি করেছে এই আইন, একই সঙ্গে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আগুনও জ্বালিয়েছে। কোভিড অতিমারি এসে সাময়িক ছেদ টানার আগে এই নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে তুমুল আন্দোলিত হয়ে উঠেছিল দিল্লি এবং দেশের নানা অঞ্চল— বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু অতিমারি শেষে অনেক বার সংসদে অধিবেশন বসলেও এই আইন নিয়ে আলোচনার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা হয়নি। সম্প্রতি আবার নতুন করে স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে সফরে এসে সিএএ-র অস্ত্রে শাণ দিলেন জোরদার। ভোটের মহাপ্রহর ঘনিয়ে আসায় পশ্চিমবঙ্গ থেকেই নাগরিকত্ব প্রদানের কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা, তিনি জানালেন।
স্বাভাবিক। ওই আইনের যে প্রকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, পশ্চিমবঙ্গেই তা সবচেয়ে বেশি সার্থক হওয়ার কথা। এই আইন কার্যকর করে দুই দিক দিয়ে এ রাজ্যে ‘সাফল্য’ পেতে পারে বিজেপি। ২০১৯ সালে সংশোধিত আইন অনুযায়ী যে-হেতু ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি (যাদের সিংহভাগই ইসলামি দেশ) থেকে ‘ধর্মীয় উৎপীড়ন’-এর কারণে যে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি ও খ্রিস্টান ‘অনুপ্রবেশকারী’রা এ দেশে চলে এসেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের সূত্রে মুসলিমদের আলাদা করার কাজ শুরু হবে। এ দেশের ভোটের প্রচারে অস্ত্র হিসাবে মেরুকরণের কার্যকারিতা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। সুতরাং, আরও এক বার তার আশ্রয় নেওয়াই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে বিজেপির লক্ষ্য। মনে রাখা দরকার, প্রতিবেশী দেশ থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা ঠিক কী কারণে এসেছেন, কী ভাবে ‘ধর্মীয় উৎপীড়ন’ প্রমাণ করবেন, ইত্যাদি কূট প্রশ্ন আছেই। তার সঙ্গে আছে আর একটি মোক্ষম প্রশ্ন: ‘মুসলিম’রা যদি অন্য দেশে উৎপীড়িত হয়ে এ দেশে এসে থাকেন, তা হলে তাঁদের কেন নাগরিকত্বের অধিকার দেওয়া হবে না? বাস্তবিক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে সিন্ধি বা মুহাজির মুসলমানরা, এমনকি শিয়া-সুন্নিরাও কখনও কখনও চলে এসেছেন সীমানা পেরিয়ে। ধর্মের ভিত্তিতে তাঁদের এই ভাবে নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বিচ্যুত করা সরাসরি ভারতের সংবিধানবিরোধী কাজ নয় কি? না কি সংসদে সংখ্যার জোর দেখিয়ে, অবশিষ্ট বিরোধীদের বরখাস্ত, বহিষ্কার, স্তব্ধবাক করেই চলবে এমন সংবিধানবিরোধী কাজকর্ম?
সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়ানো ও তাঁদের বিতাড়নযোগ্য বলে প্রমাণিত করার পাশাপাশি— পশ্চিমবঙ্গে আরও একটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন বিজেপি নেতারা: মতুয়া ভোট সংগ্রহ। তাঁদের প্রতিশ্রুতিতে সীমান্ত-পেরোনো মতুয়া জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার একটি প্রকল্প নিহিত আছে। এই অধিকার অনেক দিন থেকে এঁরা চেয়ে আসছেন, কিন্তু বিবিধ রাজনৈতিক দল নিজ নিজ স্বার্থে তাঁদের ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ‘ব্যবহার’ করলেও তাঁদের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান করা যায়নি। যায়নি, কারণ কিছু বাস্তব সঙ্কট আছে। ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইনের মতো ২০১৯ সালের সংশোধিত আইনও নিশ্চয়তা দিতে পারেনি, কোন কাগজ দেখিয়ে এই দেশান্তরিতরা ভারতে নিজেদের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন। সম্প্রতি অসমে যে ভাবে এনআরসি তালিকা তৈরির চেষ্টা হয়েছে, তাতেও সিএএ নিয়ে আতঙ্ক অনেক গুণ বেড়েছে। ‘বৈধ’ কাগজপত্র দেখাতে না পারার কারণে পশ্চিমবঙ্গেও মতুয়াদের অনেকেই অধিকারচ্যুত হতে পারেন, সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ধর্মের ভিত্তিতে ও নাগরিকত্বের ধোঁয়াটে ছাঁকনি এত তাড়াহুড়ো করে ব্যবহার করে একমাত্র কেন্দ্রীয় শাসক দলের স্বার্থই রক্ষা হতে পারে। প্রশ্ন হল, ভোটে নিজের দলের সাফল্যের জন্য আরও কত বিপন্ন করা যায় দেশ ও দেশবাসীকে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy