কাজের কি শেষ ছিল সিন্ডারেলার? ঘর পরিষ্কার, চিমনি সাফসুতরো। পরিশ্রান্ত সিন্ডারেলা শেষ পর্যন্ত কালিঝুলি মেখে সেই রান্নাঘরেই ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু সে তো গল্পে। তাকে যদি কোনও ভাবে বাস্তবের মাটিতে উড়িয়ে আনা যেত, কেমন থাকত সে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, সারা দিন ধুলো-ধোঁয়ায় পড়ে থাকা মেয়েটিকে ফুসফুসের অসুখ ধরত নির্ঘাত। তার উপর রাজপ্রাসাদে যাওয়ার আগে সাজাতে বসে পরি-মা তার উপর যে অঢেল ঝিকিমিকি জাদু-গুঁড়ো বর্ষণ করেছিল, তাতে ফুসফুসের অসুখ কি মারাত্মক বেড়ে যেত না? ওই গুঁড়ো যে আসলে অ্যালুমিনিয়ামের পরত দেওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিক। আবার ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’-এর বেলি-র কথাই ধরা যাক। বিস্টের হাতে বন্দি বাবাকে ছাড়াতে সে নিজেকে সমর্পণ করেছিল বিস্ট-এর হাতে। বিস্ট-এর চেহারায় নানা পশুর অবয়বের সংমিশ্রণ। মাথাটা মোষের, ভ্রুযুগল গরিলার, বুনো শুয়োরের দাঁত, ভালুকের শরীর আর নেকড়ের পা। এমন এক জীবের সান্নিধ্যে বেশি ক্ষণ থাকা মানে, বিজ্ঞানীদের মতে, বেলি-র ব্রুসেলোসিস, জলাতঙ্কের মতো মারণরোগে আক্রান্ত হওয়ার ষোলো আনা সম্ভাবনা ছিল। অথচ, সে-ও দিব্যি সুস্থ শরীরেই দিন কাটিয়েছে। অন্তত জটিল রোগগ্রস্ত হওয়ার খবর রূপকথার পাতায় মেলেনি।
সেই কারণেই এ সব গল্প রূপকথাতেই থেকে গিয়েছে বছরের পর বছর। বাস্তবের সঙ্গে তার যোগসূত্রটি একেবারেই অনুপস্থিত। রূপকথা আর বাস্তবের মধ্যের এই অসেতুসম্ভব ফাঁকটি নিয়েই সম্প্রতি নেদারল্যান্ডস-এর এক বিশ্ববিদ্যালয় এক মজার গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে চলেছে। সেখানে বিজ্ঞানীরা ভারী জনপ্রিয় রূপকথার চরিত্রগুলিকে বেছে নিয়েছেন এটা বোঝাতে যে, সত্যিই যদি বাস্তবে তাদের খোঁজ পাওয়া যেত, তা হলে হয়তো তাদের দিন কাটাতে হত নানা জটিল অসুখকে সঙ্গী করে। ‘স্লিপিং বিউটি’র অরোরা যে এত দিন টানা ঘুমিয়ে থেকেছিল, তাতে কি তার হার্টের রোগ, পেশির শিথিলতা দেখা দিত না? আর রাপুনজ়েলের লম্বা বেণিকে মই বানিয়ে যে সবাই টাওয়ারে ওঠা-নামা করত, তাতে কি তার হেয়ার ফলিকলস নষ্ট হয়ে যায়নি?
এই গবেষণার বিষয়টি অবশ্য আরও এক গভীর দিকে ইঙ্গিত করে। মেয়েদের এক অতিমানব বানিয়ে তুলে তাদের সাধারণ চাহিদা, অসুবিধাগুলিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার এক পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতা, যে প্রবণতা শুধু রূপকথাতেই আটকে নেই, বাস্তব জীবনেও হামেশাই ছায়া ফেলে। এ দেশে প্রায়শই মেয়েদের যে ‘দেবী’ বানিয়ে তোলার উৎকট আগ্রহ দেখা যায়, তার মধ্যে কি কোথাও ভাবা হয় দশভুজার মতো সব দিক সামলে উঠতে গিয়ে তারও কোমর-ব্যথায় বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয়? কখনও কি ভাবা হয়, সংসার আর পেশার চাপ একই গুরুত্ব দিয়ে সামলাতে গিয়ে হারিয়ে যায় তার শীতের দুপুরে আচার চুরি করে খাওয়া, কিংবা উপুড় হয়ে গল্পের বইয়ে ডুবে যাওয়ার মুহূর্তগুলো? কেন সব মেয়েকেই তাকলাগানো সুন্দরী, অসামান্য সাংসারিক জ্ঞানের অধিকারী আর আত্মত্যাগের সেরা উদাহরণ হয়ে উঠতে হবে? তারও তো সর্দি হওয়ার, পেটের ব্যথায় কাতর হওয়ার অধিকার আছে। সেই চরম কষ্টের মুহূর্তে কোনও অসম্ভব সুপুরুষ রাজপুত্তুর নয়, প্রয়োজন এক জন বিচক্ষণ চিকিৎসকের। রূপকথায় তার উল্লেখ মেলেনি। বাস্তব যেন সেই প্রয়োজন বিস্মৃত না হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy