ভারতের নানা দিকে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রতি দিনই উদ্বেগ ও দুর্ভাবনাকে নতুন নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছে। অতি সম্প্রতি কুমিল্লায় বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধাকে যে ভাবে জুতোর মালা পরিয়ে সর্বসমক্ষে হেনস্থা করা হল, এই একটি ঘটনাই বলে দেয় সঙ্কটের পরিমাণ। এই প্রবল সামাজিক ও রাজনৈতিক নির্দয়তা কী ভাবে বাঁধনহারা হয়ে প্রতিবেশী দেশকে গ্রাস করছে, তা দেখে ভারতের শাসকসমাজেরও অনেক কিছু উপলব্ধি করার আছে। ধরে নেওয়া যায়, মানুষকে এই পরিমাণ নিষ্ঠুরতায় পৌঁছে দেওয়ারও একটা পথ আছে, এবং পূর্বতন শাসকবর্গ সেই পথটি ভাল ভাবেই পরিক্রমা করেছিলেন। যে ভাবে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ক্ষমতাকে প্রায় একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের পর্যায়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন, তার থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়, ক্ষমতার আতিশয্যের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ কী ভাবে সুযোগ পেলেই ফুঁসে উঠতে পারে। অবশ্যই সাম্প্রতিক এই পরিস্থিতি উদ্ভবের পিছনে উগ্র ধর্মান্ধ মতবাদের ভূমিকা বিরাট, কিন্তু সেই মতবাদ জনসমাজে এতটা মান্যতা পাওয়ার পিছনে যে বিগত জমানার স্বৈরতন্ত্রী মনোভাব বহুলাংশে দায়ী, তা এখন প্রশ্নাতীত।
ভারতের শাসকদের পুনর্বিবেচনার মতো আরও কিছু বিষয় আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের ইউনূস সরকার সরকারি ভাবে ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঢাকার কাছে প্রত্যর্পণ করতে। স্বাভাবিক ভাবেই দিল্লি আর ঢাকার মধ্যে এক গুরুতর কূটনৈতিক সঙ্কট হয়ে উঠেছে বিষয়টি। গত অগস্টে নিজের দেশ থেকে অত্যল্প সময়ের নোটিসে ‘পালানো’র পর থেকেই হাসিনা দিল্লিতে আশ্রিত, এবং তখন থেকেই তাঁর উপস্থিতি দিল্লির কাছে গলকণ্টক হয়ে রয়েছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘ মিত্রতাসম্পর্কের পর এই আশ্রয় না দেওয়া ভারতের পক্ষে দুরূহ ছিল। আবার নতুন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে চটানোও বাঞ্ছনীয় ছিল না। অগস্টের পর থেকে ক্রমশই এই নীতিদ্বন্দ্বটি দুরূহতর হয়ে উঠেছে। ঢাকার সাম্প্রতিক পদক্ষেপের পর আশ্রিত মিত্রকে নিজের দেশে বিপদের মুখে ফিরিয়ে দিলে যে কোনও রাষ্ট্রেরই কূটনৈতিক ‘মুখরক্ষা’ অসম্ভব— বিশেষ করে যেখানে আন্তর্জাতিক নীতিই বলে দেয় যে নিজ দেশে ফিরে প্রাণসংশয় থাকলে বন্দি বা আশ্রিতকে ফেরানোর সিদ্ধান্ত কোনও দেশ না-ই নিতে পারে। আবার অন্য দিকে, এই ঘটনার পর হাসিনা বিষয়ে যদি কোনও সিদ্ধান্তই না নেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থায়ী ভাবে বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা প্রভূত। এত নিকট প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে এত বড় সঙ্কটে জড়িয়ে পড়ার যে কূটনৈতিক ধকল, তার সামনে দাঁড়িয়ে এ বার ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রককে দ্রুত ভাবতে হবে, এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর কোনও সহনীয়তর পথ আছে কি না।
ভারতীয় বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী যখন দুই দেশের পারস্পরিক বোঝাপড়ার উদ্দেশ্যে কিছু দিন আগেই ঢাকা সফরে গিয়েছিলেন, সেই সময়ে মুহাম্মদ ইউনূসের তরফে আশ্বাস মিলেছিল যে তাঁরাও বোঝাপড়ার বিষয়ে সমান আগ্রহী, উত্তেজনা বাড়ানোর পক্ষপাতী নন। প্রশ্ন উঠতে পারে, তা হলে তার পর আবার হাসিনাকে নিয়ে এই চাপ বাড়ানো হল কেন। অনুমান সম্ভব যে, সে দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এত প্রতিকূল যে ইউনূস সরকারকেও নানা দিকের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হচ্ছে। কুমিল্লার যে ঘটনাটি পূর্বে উল্লিখিত, সেই প্রসঙ্গে সরকারি অবস্থানের দোলাচলই বলে দেয় কী ভাবে সেই ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টা চলছে। ১৯৭১ সালের পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে এত কঠিন পরিস্থিতি আর কখনও আসেনি। দিল্লির প্রথম ও প্রধান কর্তব্য, এই কথাটি বুঝে নেওয়া যে, বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি ভারত নিতে পারে না। একেবারেই না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy