—ফাইল চিত্র।
চাকুরিরত অবস্থায় বেতনভুক কর্মীর মৃত্যু হইলে তাঁহাকে শহিদ বলে না; তাহা হইলে তড়িৎ-আহত হইয়া মৃত বিদ্যুৎকর্মীও শহিদ।’ ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী হানায় ২২ জন নিরাপত্তাকর্মীর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকে এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্যের জেরে গ্রেফতার হইয়াছেন অসমের শিখা শর্মা। পুলিশ এফআইআর-এ লিখিয়াছে, শিখার এই মন্তব্য ‘শহিদ’দের অসম্মান করিয়াছে, দেশের জন্য জওয়ানদের অতুলনীয় ত্যাগ স্বীকারকে ছোট করিয়া তাহাকে শুধু অর্থ রোজগারের তত্ত্বেই পর্যবসিত করে নাই, দেশসেবার ভাব ও শুচিতাকেও বাচিক আক্রমণ করিয়াছে। অতঃপর ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় শিখার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ, কদর্য শব্দ ব্যবহার, মানহানি ও ভয় দেখানোর অভিযোগ আনা হইয়াছে।
মাওবাদী আক্রমণে যে নিরাপত্তাকর্মীদের প্রাণ গিয়াছে, তাঁহাদের প্রতি সম্মান জানানো দেশবাসীর কর্তব্য। যদি কাহারও কোনও মন্তব্যে তাঁহাদের অসম্মান হয়, তাহা অবাঞ্ছিত, দুর্ভাগ্যজনক। তবে কিনা, নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার প্রশ্নটিও গুরুতর। কেহ বলিতে পারেন, প্রহরারত সেনা জওয়ান, আমপান-ধ্বস্ত নগরে স্বাভাবিকতা ফিরাইতে ব্যস্ত বিদ্যুৎকর্মী, ভোটে কর্তব্যরত শিক্ষক বা অগ্নিদগ্ধ বহুতলে কর্মরত দমকলকর্মী, দেশের প্রতিটি নাগরিক কর্মীই দিনশেষে কর্মী। প্রত্যেকেই নিজেদের কাজটি নিঃশর্ত নিষ্ঠায় করিতেছেন। কাহারও কর্মক্ষেত্র সমস্যাসঙ্কুল, জীবনাশঙ্কাপূর্ণ বলিয়াই মৃত্যুর পর তিনি ‘শহিদ’ হইতে পারেন না— শস্যক্ষেত্রের কৃষক হইতে যুদ্ধক্ষেত্রের সাংবাদিক, সকলেই দেশের জন্যই কাজ করিতেছেন। আর যে শব্দটির মর্যাদাহানি লইয়া অসম সরকার গেল-গেল রব তুলিতেছে, খোদ ভারতীয় সেনাতেই সেই ‘শহিদ’ শব্দের ব্যবহারিক প্রয়োগ নাই, আছে ‘ব্যাটল ক্যাজ়ুয়ালটি’ বা ‘অপারেশনস ক্যাজ়ুয়ালটি’ শব্দবন্ধ। প্রসঙ্গত, অভিধান বলিতেছে, ‘শহিদ’ বা তাহার সমার্থক ইংরেজি শব্দটির সহিত মিশিয়া আছে ধর্মীয় অনুষঙ্গ।
সেনা-মৃত্যু লইয়া সরকারি তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে অবহেলার অভিযোগ তুলিয়াছেন বিরোধীরা। আর বিপরীতে, রাজ্য স্তরে অসমে বা কেন্দ্রীয় স্তরে সারা দেশে বিজেপি সরকারের আচরণ প্রমাণ করিতেছে, সেনা-মৃত্যুতেও তাহারা সঙ্কীর্ণ রাজনীতিরই জল মাপিতে চাহে। সেনা জওয়ানের মৃত্যুকে একটি শব্দের মোড়কে পুরিয়া দিলে আবেগের বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনীতির হাঁড়ির হাল ঢাকা পড়িয়া যায়। বেকারত্ব, বেসরকারিকরণের ন্যায় প্রসঙ্গ হইতে অন্য দিকে নজর ফিরানো যায়। কেহ প্রশ্ন তুলিলে নাগরিকের জুটে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা বা গ্রেফতারি। ইহাই শেষ নহে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্টে সম্প্রতি উঠিয়া আসিয়াছে ‘নাগরিক স্বেচ্ছাসেবক’ নিয়োগের কথা। সহনাগরিক সমাজমাধ্যমে কী লিখিতেছেন, ‘দেশবিরোধী’ কিছু লিখিতেছেন কি না, ‘নাগরিক স্বেচ্ছাসেবক’ তাহাই দেখিবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মানির কথা মনে পড়িতে পারে, যেখানে নাগরিকদের পরস্পরের বিরুদ্ধে এমনই নজরদারি চালাইতে শিখাইয়া দিয়াছিল রাষ্ট্র। তাহা হইলে এই ২০২১ সালের ভারত তাহার অসংখ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা স্বেচ্ছায় ভুলিয়া, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও নাগরিক সন্দেহের বিষ ছড়াইবার ফ্যাসিবাদী প্রবণতাটিরই প্রবর্তন করিতে চাহিতেছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy