প্রতীকী ছবি।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কে গনিয়াছিলেন জানা নাই, যন্ত্র ও প্রযুক্তিধন্য এই কালে বরং যুদ্ধ, প্রাকৃতিক ও অন্য দুর্যোগে প্রাণহানি বা মৃত্যুর সংখ্যা গনিতে পারা সহজ। সেই কারণেই সম্প্রতি জানা গেল, এক আমেরিকাতেই কোভিড-অতিমারিতে মৃত মানুষের সংখ্যা গত জানুয়ারিতে পাঁচ লক্ষ ছাড়াইয়াছে। সংখ্যার নিরিখে ইহা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিহত আমেরিকানদের অপেক্ষাও বেশি! এই অস্বাভাবিক, অভূতপূর্ব সংখ্যা স্বাভাবিক ভাবেই খবরের শিরোনাম হইয়াছে। দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধকেও ছাপাইয়া যাইতে পারে যে অসুখ, তাহার প্রকাণ্ডতা পরিমাপের অপেক্ষা রাখে না। আমেরিকার সাম্প্রতিক অতীতে ৯/১১’র টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনায় প্রায় তিন হাজার মানুষের মৃত্যু এই সেই দিন পর্যন্ত তাহার সমুদয় বীভৎসতা লইয়া জনস্মৃতিতে জাগরূক ছিল। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিদরা বলিতেছেন, কোভিডে পাঁচ লক্ষ মানুষের মৃত্যু সেই দুঃসহ স্মৃতিকেও পিছনে ঠেলিয়াছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অপেক্ষাও বেশি মানুষ মারা গিয়াছিলেন আমেরিকার কুখ্যাত গৃহযুদ্ধে, এখন কি তবে সেই মাইলফলক ছুঁইবার শিহরিত অপেক্ষা?
পাঁচ লক্ষের ন্যায় বৃহদ্বপু সংখ্যা বলিয়াই নহে, একটি মাত্র মৃত্যুও দুঃখজনক। কিন্তু চারিপার্শ্বে প্রতিনিয়ত মৃত্যু ঘটিলে, কিংবা মৃত্যুসংবাদ আসিতে থাকিলে কি সেই দুঃখের বোধও এক কালে স্তিমিত, এমনকি নির্বাপিত হইয়া যায়? কোভিড-অতিমারি একুশ শতকের মানুষের জীবনে বোধ হয় মৃত্যু বিষয়ে সেই অননুভূতি আনিয়াছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনা সারা বিশ্বকে কাঁপাইয়া দিয়াছিল, জীবনহানি ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে তাহার বিরাট বিশাল পরিধি মানুষের জীবন আমূল পাল্টাইয়া দিয়াছিল। অথচ, কোভিড আসিয়া কেবল একটি দেশেই পাঁচ লক্ষ প্রাণ লইল— এবং তাহা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ন্যায় কয়েক বৎসর ধরিয়া নহে, মাত্র এক বৎসর সময়কালের ভিতরে— আমরা মুখে ‘অভূতপূর্ব ঘটনা’ বলিলেও তাহার অন্তর্গত তাৎপর্য বুঝিতে পারিতেছি কি? না কি মৃত্যু প্রকৃতিগত ভাবে স্বাভাবিক, কোভিডের ন্যায় বৈশ্বিক অতিমারির ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতর, সুতরাং এই পরিমাণ মৃত্যু তো হইবেই, এই যুক্তি সাজাইয়া ও মনের মধ্যে পুষিয়া মাস্ক-মণ্ডিত ও স্যানিটাইজ়ার-সিঞ্চিত হইয়া রোজকার কাজে বাহির হইতেছি? মনে রাখা প্রয়োজন, পাঁচ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হইয়াছে কোনও অনুন্নত দেশে নহে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য হইতে শুরু করিয়া সর্বক্ষেত্রে উচ্চমানের ও আধুনিক সুযোগসুবিধাযুক্ত একটি রাষ্ট্রে। এত কম সময়ের মধ্যে এত বেশি মানুষের মৃত্যু আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম, এবং এই কারণেই তাহা ভয়াবহ, অনন্যপূর্ব। মৃত্যু ছাড়াও এই ভয়াবহতার অন্য ও প্রকটতর বিয়োগান্তক দিকটি এই: এই এক বৎসরে মুহুর্মুহু মৃত্যুর মধ্য দিয়া পথ হাঁটিতে হাঁটিতে আমাদের এক প্রকার নিঃস্পৃহতা জন্মাইয়াছে। কোভিড-শুরুর দিনগুলিতে আমরা নিজেদের প্রবোধ দিতেছিলাম, এই দেশে প্রতি বৎসর পথ-দুর্ঘটনায় কি অন্য রোগে ঢের বেশি মানুষ মারা যায়, কোভিড তার বেশি কী করিবে। বিপুল মৃত্যুভার বহিয়া, এখন অতিমারির দ্বিতীয় তরঙ্গের মুখে পড়িয়াও আমাদের তত বিচলন নাই। একটি বৎসরের মধ্যে আমরা মৃত্যুর স্বাভাবিকীকরণ সম্পন্ন করিয়া ফেলিয়াছি।
ইহাই কি তবে একুশ শতকের আধুনিকতা? বিরহদহন, দুঃখ, সবই সহিয়া যায়, এমনকি মৃত্যুও— এই বোধ? রোগ-অসুখে মানুষ মরিবে, বস্তিতে থাকিলে আগুন লাগিবে, পথে বাহির হইলে গাড়ি চাপা দিতে পারে— এইরূপ অপদার্শনিক নিরাসক্তিই হয়তো আজিকার মানুষের জীবন ও বিশেষত মৃত্যু পরিমাপের নির্বিকার একক। অতিমারির বর্ণনায় যুদ্ধের রূপকল্প— ‘কোভিড-যুদ্ধ’, ‘সম্মুখসমর’, ‘ফ্রন্টলাইন কর্মী’-র ন্যায় শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হইতেছে। তাহা বহুলাংশে সত্যও। প্রিয়জন হইতে বহু দূরে, সম্পূর্ণ অপরিচিত এক বৃদ্ধ রোগীর প্রাণ বাঁচাইতে বদ্ধপরিকর হইয়া হাসপাতালে চিকিৎসা ও সেবা করিতেছেন যে স্বাস্থ্যকর্মী, তাঁহার নিকট ইহা যুদ্ধেরই শামিল। কিন্তু সেই গণ্ডির বাহিরে, বিপুল মানবসমাজের কাছে মনে হইতেছে, এমন মৃত্যু তো হইয়াই থাকে। এমনই ঘটিয়া থাকে। বিশ শতকে বিশ্বযুদ্ধের তীব্রতা মানুষকে বুঝাইয়া দিয়াছিল, মৃত্যু কত করুণ, কেমন ভয়ঙ্কর। একুশ শতকের মানুষ এক বৎসরে অতিমারির প্রতিষেধক বানাইয়া ফেলিয়াছে, আবার পাশে রাখিয়াছে এই প্রখর সত্যও: মৃত্যু হইবেই। এই যুগপৎ সক্রিয়তা ও অক্রিয়তা, সমান্তরাল তৎপরতা ও নির্লিপ্তিই তাহার আধুনিকতার অভিজ্ঞান।
যৎকিঞ্চিৎ
রাস্তা আটকে গেলে চলাফেরায় কী মুশকিল, কলকাতাবাসী বিলক্ষণ জানে। ঢাউস ঢাউস বাস-লরি ছোট ছোট রাস্তায় ঢুকে গোল বাধায়, খোদ দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল বাড়িতে ঢোকার গলি জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, কাঁড়ি উদাহরণ মিলবে। তা বলে দুই সাগরের মধ্যেকার এত বড় সুয়েজ় ক্যানাল আটকে দেবে একটা জাহাজ! এভারেস্ট, মহাকাশের পর এ বার সমুদ্রেও ট্র্যাফিক জ্যাম। বিস্তর কাণ্ডের পর সে জট ছেড়েছে, কিন্তু কেউ এক বার প্রশ্ন অবধি করল না: আর কত লম্বা জাহাজ বানাবে মানুষ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy