সর্বশক্তিমান প্রধানমন্ত্রী, মারকুটে গোরক্ষক বা অর্বাচীন হিন্দুত্ববাদীরা নন। বরং সুপ্রিম কোর্টই সম্প্রতি ৩৭৭ ধারা বিলোপ করে আমাদের প্রকৃত ভারতীয় হয়ে উঠতে সাহায্য করল। গাণ্ডীবধারী অর্জুন যে স্বেচ্ছায় স্ত্রীরূপে আর্জুনিও হতে চান, সেই রসতত্ত্ব আইনি স্বীকৃতি পেল।
অর্জুন তখন শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা দেখবেন বলে নাছোড়বান্দা। দেবী ত্রিপুরসুন্দরী তাঁকে এক জলাশয়ে পাঠালেন। সেখানে স্নান সেরে অর্জুন আভরণে বিভূষিতা সুন্দরী এক নারীতে পর্যবসিত হলেন, আগের কথা প্রায় ভুলে গেলেন। শ্রীরাধা বললেন, ‘‘এসো, তোমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করব।’’ তার পর সেই বনমধ্যে শ্রীকৃষ্ণকে দেখে নারীরূপী অর্জুন প্রেমে বিহ্বল। গোপীদের মতো তিনিও শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠলেন। পরে ক্লান্ত আর্জুনিকে কৃষ্ণ আবার জলাশয়ে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে স্নান সেরে আর্জুনি ফের হয়ে উঠলেন পুরুষ অর্জুন। কৃষ্ণ বললেন, ‘‘অর্জুন, এই ত্রিভুবনে তোমার মতো প্রিয় সখা আমার আর নেই। তাই তুমি আমার গোপন রাসলীলা দেখতে পেলে।’’
গল্পটা আছে দ্বাদশ শতকে সঙ্কলিত ‘পদ্মপুরাণ’-এ। মহাভারত থেকে ছেঁকে-নেওয়া বৈষ্ণব ভাবধারার কাব্য, কিন্তু পুরুষের নারী হয়ে ওঠার বিকল্প যৌনতা স্থান পেয়েছে সেখানেও। ওই সখীভাবে রাসলীলার মাধুর্য আস্বাদন করেই তো ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে পারেন ভক্ত অর্জুন। যৌনতার রকমফের ব্যক্তিগত, অবশ্যই! ভারতীয় সংস্কৃতি তাকে সসম্মানে স্বীকার করে নিয়েছে।
শুধু অর্জুন নন, এই সংস্কৃতিতে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও স্বেচ্ছায় নারী হয়ে যান। মহাভারতে ইরাবানের কথা আছে। অর্জুন ও নাগকন্যা উলূপীর পুত্র ইরাবান কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের হয়ে শকুনির সৈন্যদের পরাস্ত করেন। তখন দুর্যোধনের বন্ধু অলম্বুষ রাক্ষস ইরাবানকে খতম করে।
তামিলনাড়ুর কোভাগাম অঞ্চলে আবার অন্য গল্প। সেখানে পাণ্ডবদের বিজয়কল্পে ইরাবান স্বয়ং মা কালীর সামনে আত্মাহুতি দেবেন মনস্থ করলেন। কিন্তু এক রাতের জন্য হলেও মৃত্যুর আগে বিবাহিত জীবনের স্বাদ চান তিনি। তখন শ্রীকৃষ্ণ মোহিনী রূপ ধারণ করলেন। বালক ইরাবান পেল দাম্পত্যের স্বাদ। তার পর আত্মাহুতি, মোহিনীবেশী শ্রীকৃষ্ণ বিধবা রূপ ধারণ করলেন। আজও তামিলনাড়ুর কোভাগাম অঞ্চলে ইরাবানের পুজো হয়। ভক্তের যৌনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণে পার্থসারথি নিজেই নারীরূপ ধারণ করেন, এটাই ভারতীয় ঐতিহ্য।
এই ঐতিহ্যে বাল্মীকির রামায়ণও আছে। সুন্দরকাণ্ডে হনুমান রাবণের প্রাসাদে ঢুকে মুগ্ধ। পুষ্পক রথ, মণিময় সোপান, রত্নখচিত হর্ম্য দেখে দেখেও আশ মেটে না। তার পর সে এল রাবণের শয়নপ্রাসাদে। উনিশ শতকে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুবাদ: ‘‘কেহ পুনঃপুনঃ সপত্নীদিগের মুখ আঘ্রাণ করিতেছে। সকলেই রাবণের প্রতি একান্ত অনুরক্ত এবং সকলেই পান সম্পর্কে হতজ্ঞান। সুতরাং ওই সপত্নীও আবার উহাকে রাবণবোধে চুম্বন করিতেছে।’’ বাল্মীকির এ হেন বর্ণনা সত্ত্বেও রামচন্দ্র ও হনুমানজির ভক্তেরা আজকাল সমকামিতাকে ‘বিদেশি প্রভাব’ বলে গলা ফাটান!
এটাই ভারত! নবম শতাব্দীর জৈন দার্শনিক শাকটায়ন জানাচ্ছেন, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে তিন রকমের কামনা আছে। পুরুষ, নারী ও তৃতীয় কামনা। তৃতীয়টিই সব চেয়ে শক্তিশালী। কোনও মানুষ তাই বিপরীত লিঙ্গ ছাড়া সমলিঙ্গ এমনকি মনুষ্যেতর প্রাণীদের প্রতিও আকৃষ্ট হতে পারে। বিকল্প যৌনতাকে মোটেও আজকের মতো এলজিবিটিকিউ (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার, কুয়ার) বলে বন্ধনীভুক্ত করা হয়নি, স্বাভাবিক হিসেবেই মেনে নেওয়া হল।
ভীষ্ম কেন শিখণ্ডীর সঙ্গে লড়েন না? শিখণ্ডী নারী হয়ে জন্মেছিল বলে? রথারূঢ় যে দ্রুপদপুত্র একের পর এক তির ছুড়ে ভীষ্মকে শরশয্যায় শুইয়ে দিল, সে নারী না পুরুষ?
তার আগেই উদ্যোগপর্বে ভীষ্ম এক গোপন খবর জানিয়েছেন। রাজা দ্রুপদ তাঁর মেয়ে শিখণ্ডিনীর প্রকৃত পরিচয় লুকিয়ে দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মনের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন। স্বাভাবিক ভাবে সে মেয়ে কয়েক দিনের মধ্যে জেনে যায়, তার স্বামী আদৌ পুরুষ নয়।
রাজকন্যার সখীদের মাধ্যমে খবরটা পেলেন হিরণ্যবর্মন। ছলনার শাস্তি দিতে দ্রুপদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন তিনি। শিখণ্ডিনী দেখলেন, তাঁর জন্যই মা, বাবা এবং গোটা পাঞ্চাল রাজ্যের বিপদ। তিনি জঙ্গলে চলে গেলেন। সেখানে স্থূণাকর্ণ নামে এক যক্ষ তাঁর দুঃখের কাহিনি জেনে বিগলিত হলেন। শিখণ্ডিনীর সঙ্গে তিনি লিঙ্গবিনিময় করলেন। দ্রুপদতনয়া পুরুষচিহ্ন ধারণ করে প্রাসাদে ফিরে এলেন। মহাভারত এ ভাবেই বহুত্বের কথা বলে। সেই বহুত্বকে স্বীকার না করলে ভ্রান্তির অতলে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। তখন গণেশের শুঁড়ে প্লাস্টিক সার্জারির মতো শিখণ্ডীতে সেক্স চেঞ্জ অপারেশন খুঁজতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এই রায় ঘোষণায় বলেছিলেন, ‘‘ধারাটি অযৌক্তিক, নিয়মবহির্ভূত। তা এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের সমান অধিকারে হস্তক্ষেপ করে।’’ সমান অধিকারের ধারণা ব্রিটিশদের ছিল না। ১৮৬০ সালে ব্রিটেনে সোডোমি বা পায়ুকামিতার বিরুদ্ধে আইন পাশ হয়। আইনটি সে আমলের নিরিখে প্রগতিশীল। আগে ব্রিটেনে পায়ুকামের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। নতুন আইনে দশ বছরের জেল। কিন্তু পরের বছর সেই ব্রিটিশরাই যখন এ দেশে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা আনলেন, পরিষ্কার বলা হল, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। যাঁরা কথায় কথায় জাতীয়তাবাদের হুঙ্কার ছাড়েন, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে কেন যে দু’হাত তুলে সমর্থন না জানিয়ে মৌনী বাবা সেজে বসে আছেন, বুদ্ধির অগম্য।
এই ৩৭৭ ধারা তুলে দেওয়া ঋগ্বেদের ঐতিহ্যেও সাযুজ্যপূর্ণ। ঋগ্বেদের অন্যতম প্রধান দেবতা অগ্নির বাবা নেই। দুই মা: পৃথিবী এবং স্বর্গ। যজ্ঞস্থলে অগ্নি কী ভাবে উৎপন্ন হয়? কাঠে কাঠ ঘষে। কাঠগুলিকে বলে অরণি। উল্লেখ্য, অরণি শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ। দু’টি কাঠ পরস্পরের মধ্যে প্রবিষ্ট হলে অগ্নির জন্ম হয় না। তাদের পরস্পরের সঙ্গে ঘষতে হয়। ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলে ২৮ নম্বর সূক্তের তৃতীয় শ্লোক: হে জ্ঞানবান অধ্বর্যু! তুমি ঊর্ধ্বমুখ অরণিতে অধোমুখ ধারণ করো; তৎক্ষণাৎ গর্ভবতী অরণি অভীষ্টবর্ষী অগ্নিকে উৎপন্ন করিল।
তাই সমপ্রেম থেকে বিষমপ্রেম, সব কিছু যা ধারণ করে, তা-ই ধর্ম। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও এখন ভয় একটাই কারণে। ধর্মের অর্থ আজ সঙ্কুচিত। গোমাংস খায়, না খায় না? যে দেশে হিন্দু-মুসলিম মিশ্র দম্পতি বাড়িভাড়া পান না, সে দেশে বাড়িভাড়া পাবেন সমপ্রেমী দম্পতি? পাবেন বিবাহবন্ধনের স্বীকৃতি? মিলবে পারিবারিক জীবনবিমা ও চিকিৎসাবিমার সুযোগ? স্কুলে ভর্তির সময় এঁদের দত্তক সন্তান পাবে সমান সুযোগ? সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রাথমিক আইনি বাধাটা তুলে দিয়েছে, এখন এগিয়ে আসতে হবে জনসমাজকে।
এই জনসমাজ এখনও হোমোফোবিয়া বা হোমো আতঙ্কে ভোগে। এই আতঙ্কটা আগে দূর করা দরকার। সাহিত্য জানাচ্ছে, আধুনিক যুগের সূচনাতেও এই আতঙ্ক ছিল না। ১৯১২-১৩ সালে এ দেশে এসেছিলেন ‘প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’র লেখক ই এম ফরস্টার। তাঁর পৃষ্ঠপোষক, ছত্রপুরের মহারাজা বিশ্বনাথ সিংহ বাহাদুর কী ভাবে সুন্দর ছেলেদের দেখে আকৃষ্ট হতেন, এমনকি তিনি নিজেও কী ভাবে এক বালকের প্রেমে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন, লিখে গিয়েছেন ফরস্টার। তার পর একশো বছরও কাটেনি, ভারতীয় বিক্রম শেঠকে যৌনতার আত্মপরিচয় খুঁজতে হয়েছে সংশয়ে, সংক্ষোভে: In the strict ranks/ of Gay and Straight/ What is my status? Stray? Or Great?
বাংলা অনুবাদ ইচ্ছাকৃত ভাবেই করলাম না। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় বিক্রমদের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। না, যৌনতায় কে বিষমকামী বা স্ট্রেট আর কে সমকামী বা গে, সেই দ্বিকোটিক বিভাজনে আমরা আর বিশ্বাসী নই। আমরা সকলেই সমান। সেই ভাবেই খুঁজে নেব জীবনের ‘গোল্ডেন গেট’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy