Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
হতাহতের সংখ্যাই যেন গণতন্ত্রের ‘আসল’ মাপকাঠি

হে মোর দুর্ভাগা দেশ!

আবার পঞ্চায়েত-কাণ্ড। আবার খুনোখুনি। আবার কলঙ্কিত গণতন্ত্র। বহু ব্যবহারে ধারালো অস্ত্রও নাকি ভোঁতা হয়ে যায়।

শাসন: গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আমডাঙা, ৩১ অগস্ট

শাসন: গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আমডাঙা, ৩১ অগস্ট

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

আবার পঞ্চায়েত-কাণ্ড। আবার খুনোখুনি। আবার কলঙ্কিত গণতন্ত্র। বহু ব্যবহারে ধারালো অস্ত্রও নাকি ভোঁতা হয়ে যায়। পঞ্চায়েত সংক্রান্ত কথাগুলি লিখতে লিখতে সেটাই মনে হচ্ছিল। কারণ গত কয়েক মাসে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে সন্ত্রাস, জুলুম, প্রাণহানি, গণতান্ত্রিক অধিকার ইত্যাদি শব্দ এত বার ব্যবহৃত হয়েছে যে, আজ আবার নতুন করে তা হয়তো কোনও বাড়তি মাত্রা বহন করে না। বেচারা জনগণ এত দিনে নির্ঘাত বুঝে গিয়েছেন, এমনটাই হয় এবং হবে। কিন্তু কেন হবে, সেই উত্তর দেওয়ার কেউ নেই।

একটি বিষয়ে সবাই নিশ্চয় একমত হবেন যে, এ বারের পঞ্চায়েত ভোট প্রতিটি পর্বে যে ভাবে অগ্নিগর্ভ হয়েছে, ততটা এর আগে কখনও হয়নি। এতে কার দায় দশ আনা, কার ছ’আনা, কার পুরো ষোলো আনা, সেই ভাগ-বিচার এ ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। ঘটনা হল, গ্রামবাংলায় যত রক্ত ঝরেছে, যত প্রাণহানি হয়েছে, সন্ত্রাস যে ভাবে শুভবুদ্ধিকে গ্রাস করেছে, সেটা আতঙ্কজনক। একটি ভোট প্রক্রিয়া কেন্দ্র করে বার বার আদালতের হস্তক্ষেপও সুস্থ গণতন্ত্রের পক্ষে অশনি সঙ্কেত।

তবু এত কিছুর পরেও সামগ্রিক ফলাফলে প্রত্যাশা মতোই তৃণমূলের বিপুল জয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা ৩৪ শতাংশ আসনও তৃণমূলের থেকে গিয়েছে। কিন্তু সন্ত্রাস বন্ধ হল কই?

বোর্ড গঠন নিয়ে অনেকগুলি জেলায় আবার নতুন করে হিংসা যে ভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে, তাতে গণতন্ত্রের বিপন্নতা ফের স্পষ্ট। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গিন যে, মালদহের মানিকচকে ক্ষমতা দখলের যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ তিন বছরের এক শিশু এখন জীবনযুদ্ধ লড়ছে। সেখানেই নিহত দুই সাধারণ মানুষ। মনুষ্যত্বের এর চেয়েও নির্মম অবনমন আর কী হতে পারে! যে পঞ্চায়েতের দখল নেওয়ার জন্য এই লড়াই, সেই বোর্ড পেয়েছে তৃণমূল।

উত্তর চব্বিশ পরগনার আমডাঙাতেও একটি গ্রাম পঞ্চায়েত দখলের যুদ্ধে মোট তিনটি প্রাণ গিয়েছে। যাঁদের দু’জন তৃণমূলের এবং এক জন সিপিএমের বলে দাবি। সংঘর্ষের সুবাদে জানতে পারা গেল, সেখানে গোটা তল্লাট কার্যত অস্ত্রাগার ও বিস্ফোরকের গুদাম হয়ে উঠেছিল। অস্ত্রবলে বলীয়ান ছিল সকলেই। আর সেই সব মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে ‘গণতন্ত্র’ রক্ষায়— অর্থাৎ, জনগণের দ্বারা নির্বাচিতদের নিয়ে বোর্ড গড়ার কাজে! সেই প্রক্রিয়া অবশ্য আপাতত শিকেয় উঠেছে।

মানিকচক বা আমডাঙা দু’টি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ মাত্র। আসল বিষয় হল প্রবণতা। কারণ এ সবের পরেও হিসেব কষা হয়। নেতারা অঙ্ক-টঙ্ক করে জানিয়ে দেন, নিহতের সংখ্যায় কারা এগিয়ে! যেমন এখন, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় বোর্ড গঠনের লড়াইয়ে নিহতদের মধ্যে শাসক তৃণমূলই সংখ্যাগরিষ্ঠ। পরিসংখ্যান দেখায়, নিহত আট জনের মধ্যে পাঁচ জন শাসক দলের, দু’জন বিজেপির এবং এক জন সিপিএমের। স্বাভাবিক ভাবেই সংখ্যাতত্ত্বকে নস্যাৎ করতে পাল্টা যুক্তিও কম নেই। ফলে রাজনীতির মরুতে হারিয়ে যায় রক্তের স্রোত। আর চাপান-উতোর দেখলে মনে হয়, যেন হতাহতের সংখ্যাই গণতন্ত্রের ‘আসল’ মাপকাঠি! যেন শাসকের রক্ত বেশি ঝরল, না কি বিরোধীদের— তার ভিত্তিতেই স্থির হবে গণতন্ত্র কখন, কতটা ‘সক্রিয়’!

এর পরেও রয়েছে দল ভাঙাতে টাকার খেলা, পুলিশ প্রশাসনকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর অপচেষ্টা ইত্যাদি। টাকার খেলা সংক্রান্ত ফোনালাপের একটি অডিয়ো ক্লিপ তো ইতিমধ্যেই বাজারে ঘুরছে। যাতে তৃণমূল ভাঙাতে

বিজেপির কৌশল পরিষ্কার। দলের লোকেরাও মানছেন, ফোনের কণ্ঠস্বর বিজেপির নদিয়া জেলার সভাপতি মহাদেব সরকারের সঙ্গে মিলে যায়। বিজেপি অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে প্রমাণ করছে, এই খেলায় শরিক হতে তারা বিশেষ নারাজ নয়।

তৃণমূলের অনুব্রত মণ্ডলই বা কম কী! পঞ্চায়েত নির্বাচনের গোটা মরসুম জুড়ে বীরভূমের এই ‘বীর’ সন্তানের নানা কীর্তিকলাপ মানুষ দেখেছেন। এর আগেও পুলিশকে বোমা মারার হুমকি দেওয়া থেকে শুরু করে ‘দাদাগিরি’র নিত্যনতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তৃণমূলের এই কেষ্ট। আর কয়েক দিন আগে রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘গাঁজা কেস দিয়ে’ জেলে পোরার কৌশল প্রকাশ্যে বলে ফেলে তিনি শুধু নিজের মুখেই নয়, শাসক দলের মুখেও কালি লাগানোর ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছেন। এ শুধু ফোনের গলা নয়, একেবারে ভিডিয়ো প্রমাণ। বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্বের মুখেও কুলুপ।

নদিয়ার মহাদেব বা বীরভূমের অনুব্রতেরা দাবার ছকে নিছক বোড়ে! আসলে যুগে যুগে, কালে কালে সমালোচক বা বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের দাবিয়ে রাখাটাই শাসকেরা পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করেছেন। কী বা দেশ, কী বা রাজ্য— এর কোনও ব্যতিক্রম হয় না। আর যে যখন ক্ষমতায় থাকে, পুলিশ-প্রশাসনের লাগাম হাতে থাকার ফলে তাদের পক্ষে কাজটাও সহজ হয়। ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থাই বলুন বা নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের ‘হিন্দুত্বের’ তাড়না, জ্যোতি বসুর দলের অর্বাচীন ঔদ্ধত্যই বলুন বা তৃণমূলের বল্গাহীন অসহিষ্ণুতা— সবই আদতে এক দেহে লীন। শাসকের বিরুদ্ধাচরণ অথবা কোনও সমালোচনা নৈব নৈব চ! তা হলে তার ‘ফল’ ভুগতেই হবে!

হে মোর দুর্ভাগা দেশ! গণতন্ত্রের এমন রুদ্ররূপ আরও কত দিন দেখতে হবে, কে জানে! আমাদের দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার সত্তর বছর পার করে এসে আজ নতুন করে গণতন্ত্রে বিরোধী মত প্রকাশের প্রয়োজনীয়তার পাঠ শেখাচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট! সর্বোচ্চ আদালত কার্যত বুঝিয়ে দিয়েছে, সর্বদা শাসকবর্গের তালে তাল দিলেই গণতন্ত্র পরিপুষ্ট হয় না। সেখানে ভিন্নমতের গুরুত্ব অপরিসীম। বিরুদ্ধ মতের সেফটি ভাল্ভ যদি খুলতে দেওয়া না হয়, গণতন্ত্রের প্রেসার কুকার ফেটে গিয়ে বিপদ তা হলে অনিবার্য। সরকারের ধামা না ধরা বিশিষ্ট কয়েক জনকে প্রধানমন্ত্রীকে খুনের চক্রান্তের শরিক বলে দাগিয়ে দিয়ে যে ভাবে জেলে পোরা হয়েছিল, তার ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের ওই পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।

অভিযোগ খুবই গুরুতর। সত্যাসত্যও বিচারসাপেক্ষ। সেই আলোচনায় যাব না। কিন্তু বিরোধী কণ্ঠস্বর যে গণতন্ত্রের সেফটি ভাল্ভ এবং তা রুদ্ধ করার প্রবণতা যে স্পষ্ট, তেমন আভাস আদালতের মন্তব্যে বেরিয়ে আসে। দলমতনির্বিশেষে রাজনীতির কারবারিদের পক্ষে এটা খুব মর্যাদার বিষয় হতে পারে না।

রাজনীতির কুশীলবেরা যদি এখনও এটা বুঝতে না চান এবং নিজেদের সংযত না করেন, তা হলে ভবিষ্যতের জন্য থাকবে শুধু সর্বগ্রাসী অন্ধকার। সেই আঁধার যদি সকলকেই গিলে খায়, তাতে

লাভ কার?

অন্য বিষয়গুলি:

Democracy Death Measurement Scale
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE