Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

যথার্থ গুণগ্রাহীর সংখ্যা কমছে

‘ভদ্রলোক বাঙালি কমিউনিস্ট’দের আধিপত্য শেষ পর্যন্ত শ্রমজীবী মানুষের সংস্কৃতিকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিতে সমর্থ হল।

কৌশিক সেন
শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:২২
Share: Save:

এক সময় বহুচর্চিত একটি উক্তি— ‘আমি ভদ্রলোক নই, কমিউনিস্ট।’ বক্তা বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র মহাশয়। তিন দশক আগের করা সে উক্তিতে ছিল তীব্র আক্ষেপ, বিদ্রোহ ও আত্মবিশ্লেষণ। এই আত্মবিশ্লেষণ ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত। বাংলায় বামপন্থী চিন্তার যে ভাল ও গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি আমাদের চেতনাকে আলোড়িত করে, সেগুলি একই সঙ্গে এক গভীর অন্তর্বিরোধে বিষণ্ণও করে। ‘ভদ্রলোক বাঙালি কমিউনিস্ট’দের আধিপত্য শেষ পর্যন্ত শ্রমজীবী মানুষের সংস্কৃতিকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিতে সমর্থ হল। না পারল নিজের পিছুটান ছেড়ে বৃহত্তর সমাজের মধ্যে মিশে যেতে, না পারল বৃহত্তর সমাজকে নিজের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে আসতে।

বাঙালির সংস্কৃতির ভুবনটি, অর্থাৎ গান, নাটক, সিনেমা, সাহিত্য প্রভৃতি সব দিকে তাকালে যে নির্মম সত্যটি প্রকাশ হয়ে পড়ছে, তা হল এই সমস্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলিকে যাঁরা লালন করবেন, সেই গুণগ্রাহীদের সংখ্যা খুব দ্রুত কমছে। অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গের আমজনতার যে বিনোদন জগৎ, সেই জগতের সঙ্গে এই মুহূর্তে এক জন চিত্রকর বা এক জন কবি, কিংবা এক জন নাট্যকার, অথবা এক জন চলচ্চিত্র নির্দেশকের রুচির মিল হওয়া অসম্ভব। যে শিল্পীরা প্রতি মুহূর্তে সমাজের গভীর সমস্যাগুলি অনুভব করে অত্যন্ত দায়িত্ব নিয়ে তাঁদের আশঙ্কা, বিশ্বাস, রাগ, ভয়, আশা প্রকাশ করতে চাইছেন, সেই প্রকাশের মাত্রাবোধটি একটা সূক্ষ্মতার মধ্যে বেঁধে রাখতে চাইছেন এবং অবশ্যই কোনও রকম সামাজিক-রাজনৈতিক ছকের মধ্যে বাঁধা পড়তে চাইছেন না— সেই সব কবিতা, গান, ছবি, নাটক, চলচ্চিত্র এই বৃহত্তর দর্শকদের থেকে সহস্র যোজন দূরে। যে নিবারণ পণ্ডিত শম্ভু মিত্রের মুখে রবীন্দ্রনাথের আবৃত্তি শুনে শিহরিত হয়েছিলেন, সেই সব মাটির সঙ্গে সংলগ্ন শিল্পীরা এত যুগ পরে এত অবহেলা সহ্য করেছেন যে দু’পক্ষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় বা সংযোগ তো স্থাপন হয়ইনি, উপরন্তু আমরা একে অপরের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা।

আর এই নানা ফাঁকফোকর ও জটিলতার ভিতর দিয়ে ঢুকছে এমন এক স্থূলরুচিসম্পন্ন উৎসব আর উল্লাসের স্রোত, যা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যাবতীয় গভীর ও সূক্ষ্ম ভাবনা-চিন্তার বাঁধ। একটা অদ্ভুত সহজ ও চটকদারি বিবেচনা ও বিশ্লেষণের মায়াজালে জড়িয়ে পড়ছি আমরা। সম্প্রতি ‘ময়ূরাক্ষী’ চলচ্চিত্রে স্মরণীয় অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, যা আদায় করে নিয়েছে বহু মানুষের ভালবাসা ও সমালোচকদের সম্ভ্রম। কিন্তু আমার অবাক লাগে, যখন দেখি, বুদ্ধিমান-মননশীল বাঙালি বলে, ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় নিয়ে আর কী-ই বা বলা যায়! উনি তো এমন আগেও কত করেছেন বা ‘তিনি’ এমন চরিত্রে কী করতে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়’— ইত্যাদি। যে শিল্পীর ‘লেজিয়ঁ দ্য’নর’ পাওয়ার গর্বে আমরা উদ্বেল হই, সেই শিল্পী এতটা বয়সে পৌঁছে, জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পার হয়ে কোন অনন্য প্রেরণায় এমন চরিত্র সৃষ্টি করতে পারেন, তা বোঝার এবং বিশ্লেষণ করার দায় আমাদের আছে। এখানে আমরা, যাঁরা ভদ্রলোক এবং বাঙালি। আমরা, যাঁরা সৌমিত্র ‘দাদাসাহেব ফালকে’ সম্মান পেয়েছেন বলে বুকটান করি।

একটা চরিত্র, যে ইতিহাসের অধ্যাপক। সচেতন, মননশীল এক মানুষ। সেই মানুষটি আস্তে আস্তে বয়সের কারণে, নানা শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় আটকে পড়ছেন। বিশ্বাসঘাতকতা করছে স্মৃতি, মনকে গ্রাস করছে গভীর অবসাদ। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান তো ছেড়ে কথা বলবে না। সংগত কারণেই সে নানা ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চাইবে যতটা সম্ভব সুস্থ করে তুলতে। সুশোভন হঠাৎই কোনও এক সকালে চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে যখন ঘুমিয়ে পড়েন, ছেলের স্পর্শে যখন ঘুম ভেঙে অস্পষ্ট চোখে তাকান, তখন বোঝা যায় ওটা নিছক বার্ধক্যজনিত ঘুম নয়। ওটা ওষুধের প্রভাব এবং মানুষটির মনে বাসা বেঁধেছে এক অনিবার্য অবসাদ, যা তার স্নায়ুকে অবশ করেছে, ক্লান্ত করেছে। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না, কী পরম নৈপুণ্যে ও বিশ্বাসযোগ্যতায় সৌমিত্র এই ক্লান্তি আর অবসাদকে নির্মাণ করেন।

‘নির্মাণ’ কথাটা সচেতন ভাবে ব্যবহার করলাম, কারণ এমনটা যদি ধরে নিই যে সৌমিত্রের মতো এক জন অভিজ্ঞ অভিনেতা এমন ‘চরিত্র’ নির্মাণ করতে অবশ্যই পারেন, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, তা হলেও সেই বিস্ময় পুলকে পরিণত হয় তখন, যখন সৌমিত্র ‘সুশোভন’ চরিত্রের অন্য দিকটা ‘সৃষ্টি’ করেন। নিজের মনের অবসাদ ও শারীরিক বাধা অতিক্রম করে যখন সুশোভন দেখতে পান যে, তাঁর পুত্রের মন ভাল নেই, বার বার বলেন তাঁকে ময়ূরাক্ষীর কাছে যেতে, যে ময়ূরাক্ষীর ভালবাসা টলমল করা বুকে শুশ্রূষার শীতল ছায়া দেখেছিলেন সুশোভন। চকিতে সত্যকে চিনতে পারে যে মানুষ, জানার বোধে যখন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর মুখ, চোখ, তখন বোঝা য়ায় এক জন সত্যিকারের বড় মাপের অভিনেতার পরিধি কতটা। এক জন প্রকৃত শিল্পী শুধু রক্তমাংস, চামড়া, হাড় দিয়ে তৈরি একটা সচল মানুষ ‘নির্মাণ’ করেন না, বরং এমন একটা মানুষ ‘সৃষ্টি’ করেন, যা আমাদের মনকে একটা অভিনব স্তরে নিয়ে যায়।

অন্য বিষয়গুলি:

cultural activist Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy