ঈশানী দত্ত রায়ের ‘আকাশ ভরা হেমন্তকাল’ (১৫-১১) পড়ে মনটা যেন এক বিষণ্ণতার ভাল-লাগায় ডুবে গেল। বিপজ্জনক হারে বেড়ে চলা দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিপন্ন গাছপালা আর প্রাণী-জগৎ সারা পৃথিবীকেই তার ঋতুবৈচিত্র ভুলিয়ে দিচ্ছে। ছোটবেলায় সাধ করে লেখা রচনা ‘বাংলার ছয় ঋতু’ এখন শুধু পাঠ্যবইয়ের পাতার আড়ালে উঁকি মারে। তবুও হেমন্তকাল বাংলার মাটিতে যেন এক অতিপ্রাকৃত মায়া বিছিয়ে রাখে। আসন্ন নবান্ন উদ্যাপনের ইশারা আর গাঢ় হিমেল হাওয়ার মরসুমি প্রাক্কথন নিয়ে বাংলার আনাচেকানাচে তার নীরব অথচ অব্যর্থ উপস্থিতি টের পাওয়া যায় আলোর উৎসবের শেষ প্রান্ত থেকেই। আর সেই সঙ্গে হেমন্তে বাংলার সত্তা জুড়ে যেন জীবনানন্দের অলৌকিক মায়াবী উপস্থিতি। এ পোড়া দেশকে লাজুক কবি বিনম্র, অনুচ্চার ভালবেসেছিলেন আজীবন। হেমন্তের মধ্যে মৃত্যু আর মগ্নতার এই ঘ্রাণকেই যেন নিজের জীবনদর্শন বলে চিনেছিলেন তিনি। তাই বোধ হয় জীবনানন্দের এই তিলোত্তমা মহানগরে হেমন্তের পদচারণা শোনা যায় এখনও, যদিও তার ছন্দ অনেক স্তিমিত, ম্লানতর। হেমন্তের শেষ বিকেলের পিঠে এলিয়ে পড়া সেই নাগরিক রোদকে তাই এত ভাল লাগতে থাকে, ওয়েলিংটনে পশমের পসরা জড়ো হতে থাকে পরিযায়ী পাখির নিয়মে, জাদুঘরের সামনে নতুন-পুরনো ইংরেজি বইপত্র মিঠে রোদ মাখতে থাকে। হেমন্ত এখনও জানান দিয়ে যায়, শীত আসছে। আমাদের প্রাত্যহিকতার ঘানি-টানা শুকনো অস্তিত্বে এই মায়াময় লেখার মাধ্যমে আবার একটু নস্টালজিয়ার জল পড়ল।
শান্তনু মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৯১
প্রতিচ্ছবি
‘আকাশ ভরা হেমন্তকাল’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে বাক্রুদ্ধ হয়ে গেলাম! হেমন্তের সিগনেচার বিষণ্ণতা সারা বছর ধরে উদ্যাপন করতে চাওয়া আমি এ লেখায় এই ঋতুকে দেখলাম, যেন টি এস এলিয়টের কবিতার টেবিলে শায়িত সংজ্ঞাহীন রোগীর মতো, আর প্রবন্ধকারকে দক্ষ চিকিৎসকের মতো। এত সাবলীল ভাবে এই সর্বজনীন ‘রক্তঝরা ক্ষত’র আলাদা অস্তিত্বকে জনসমক্ষে বেআব্রু করার নির্ভীকতাকে কুর্নিশ। মানবসভ্যতার সবচেয়ে ‘ডিপ্রেসড’ প্রজন্ম হিসাবে স্বীকৃত জেন জ়ি-র প্রতিনিধিত্ব করে বলতেই পারি, এই লেখা আমাদের অনেকেরই মনের অবিকৃত প্রতিচ্ছবি। আমাদের কাছে এই লেখার প্রতিটি শব্দই হেমন্তের আকাশব্যাপী নিঃসঙ্গতার সহানুভূতিশীল আলিঙ্গন। আমরা যারা একবিংশ শতাব্দীর উত্তরাধুনিক মানুষ, যারা শেক্সপিয়রের সনেট ৭৩-র শেষ দু’টি পঙ্ক্তির সঙ্গে সহমত হতে চাই কিন্তু পারি না, তাদের মনের মণিকোঠায় এই প্রবন্ধ ছাতিম ফুলের উগ্র গন্ধের মতো নয়, মৃত নক্ষত্রের ঋণাত্মক অবশিষ্ট আলোর মতো সত্যি।
শরণ্যা দাশ, কলকাতা-৭৫
ত্যাগের বার্তা
ছাতিম ফুলের গন্ধের মাদকতায় বয়ে আনা বিষাদের সুর ঈশানী দত্ত রায়ের মর্মস্পর্শী প্রবন্ধটিতে গভীর ভাবে বিদ্যমান। আমি স্মৃতিবিধুরতায় আক্রান্ত। সেই কবেকার শিশির সেচে গণ্ডূষ দেওয়ার প্রথা মনকে নিয়ে গেল নিরুত্তাপ, নির্মল দিনগুলোতে।
আমাদের জীবনের আকাশে বিষাদ দখল করে অর্ধেকের বেশি অংশ। সেই শিশুবেলায় বিষাদের আগমন হত এই হেমন্তেরই রাতে! দুর্গাঠাকুরের বিসর্জন, শান্তির জল নেওয়া, তার পর আবার পড়তে বসার, নিত্য কাজে ফিরে যাওয়ার বিষণ্ণতা; তার সঙ্গে বাৎসরিক পরীক্ষার উৎকণ্ঠা। ঘর ভরা অতিথি-আত্মীয়স্বজন যখন বাড়ি ফিরে যেতেন, তখনও ভরা বসন্তে মন জুড়ে থাকত এই বিষণ্ণতার মেঘ।
এ বার কিন্তু ছাতিম ফুল দু’বার ফুটল গাছ ভরে! হঠাৎ বৃষ্টিতে ঝরে গিয়েও আবার দেখা দিল। বার্তা দিল— “এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া!” পূর্ণতার টান, অসীমের টান মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতোই মনের ধূসর আকাশে স্থায়ী অথচ সুপ্ত ভাবে মিশে থাকে। হরেকরঙা ফুলের মতো জীবনের বসন্তে, গ্রীষ্মে বা বর্ষায়। অথচ প্রৌঢ়ত্বের হেমন্তে এই বিষাদ আসে আকাশপ্রদীপের মতো চেতনাকে উন্মেষ করতে।
পাতা ঝরার দৃশ্য মনকে ভাবায়, কাঁদায়। গা-সওয়া উপলব্ধিগুলো যেন আস্তে আস্তে দ্বার খোলে অনন্তের দিকে। বিষাদও বুঝি ভরসা জোগায় অতিজাগতিক শক্তির উপলব্ধিকে আরও গভীর ভাবে। ক্ষণিকের হেমন্ত বড় মিষ্টি করে বুঝিয়ে দেয় ভোগের পরিশেষে ত্যাগের বার্তাটিকে।
শর্মিষ্ঠা দাশ, কলকাতা-৩১
জীবনের জয়গান
একলা বসে বাঁশি শোনার মাহেন্দ্রক্ষণ যখন আসে, বাক্যরাশির মুখরতা তখন নীরবতায় মুখ লুকায়। ‘আকাশভরা হেমন্তকাল’ পড়ে মনে হল, ভাল-লাগা ফুরিয়ে যায়নি তা হলে। আশ্বস্ত হওয়া গেল। দিবসের কোলাহল এক নিমেষে যেন কোথায় উধাও। শব্দের জাল ভেদ করে এগোতে এগোতে টের পেলাম, ভাললাগার অনুভূতিটুকু অমলিন রেখেই মনের কোণে বিষাদও যেন উঁকি মারছে।
হেমন্ত কি সত্যিই বিষাদ-ভরা! কী জানি, হবেও বা। প্রথিতযশা শিল্পী মান্না দে নাকি এক বার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুযোগের সুরে বলেন, আপনারা মশাই গান লেখেন, ভালই লেখেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা, কবিতার ভাষা এক বার পড়ে দেখুন তো... চোখের সামনে দেখতে পাবেন সেই দৃশ্যটা। পুলকবাবুকে প্রকৃতি পর্যায়ের কিছু গান তিনি শুনিয়ে বেশ খানিকটা ভাবনার খোরাক দিয়ে ওই ধারার কিছু গান রচনার জন্য অনুরোধ করেন। এর পর পুলকবাবু শিল্পীর জন্য ‘সারা বছরের গান’ লেখেন, সুর করেন শিল্পীর অনুজ প্রভাষচন্দ্র দে (শিল্পী অবশ্য তাঁকেও গানের উপযোগী কাঠামো শুনিয়ে দিয়েছিলেন)। হেমন্ত ঋতুর গানটি ছিল ‘জ্বালাও আকাশপ্রদীপ’। সেটা ১৯৭৮ সাল। এই পর্যায়ের গানগুলো যাঁরা শুনেছেন, এক বার স্মরণে আনুন গানটির সুর, যেন বিষাদমাখা, নয় কি? প্রবন্ধকারও তাই যথার্থই খুঁজতে চেয়েছেন— হেমন্ত তবে কী? বিষাদ, কুয়াশা, ঋতুবদলের যন্ত্রণা? এর উত্তর কে-ই বা জানে। সীমার মাঝে অসীমের খোঁজ তো অন্তহীন। গোধূলিতে যখন আঁধার নামে, ঘরের প্রদীপকে তো তখনই বাইরে নিয়ে যাওয়ার ডাক শোনা যায়।
তাই যে হেমন্ত-সন্ধ্যায় জ্বলে উঠল ‘দ্রোহের আলো’, সে আলো যেন বিষাদরজনী শেষে ‘নূতন উষালোক’-এ নিয়ে আসে নবীন আনন্দ। তবেই না জীবনের জয়গানের সার্থকতা।
বরুণ কর, ব্যান্ডেল, হুগলি
নীরবে আসে
ঈশানী দত্ত রায় তাঁর প্রবন্ধে এক সংশয়ের জন্ম দেন, তবে হেমন্ত কি শুধুই বিষাদ, কুয়াশার? হেমন্তকে মেটাফর করে প্রবন্ধকার ডুবে গিয়েছেন চিন্তার গভীরে। এ যেন জন কিটসের ‘ওড টু অটাম’ কবিতার মতো সময়ের উপস্থিতিতে প্রকৃতি আর অভিজ্ঞতার যৌথ অভিযান। হেমন্ত মিশ্র অনুভূতির আড়ালে এক দ্বান্দ্বিকতা তৈরি করে, যা উত্তরণের পথ প্রশস্ত করে। পৃথিবীর গভীর অসুখে হারিয়ে যাচ্ছে হেমন্তের স্নিগ্ধতা। জীবনভোগের সব আয়োজন থাকলেও সুখের ঠিকানা কেউ জানে না। কারণ সময় বড়ই নির্বোধ, অস্থির। সমান্তরাল সম্পর্কের রাস্তায় সঙ্গী শুধু একাকিত্ব আর যন্ত্রণা। সুখের চাবিকাঠি হয়ে হেমন্ত আজও সুরঞ্জনা, যার কাছে ‘কী চেয়েছে? কী পেয়েছে?— গিয়েছে হারায়ে’— এ সব মূল্যহীন। বরং হেমন্তের কাছে রয়ে গেছে, ‘মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়’। হেমন্ত সময়ের অলীক সৌন্দর্য। সে নীরবে আসে, আবার চলেও যায় নীরবে। হেমন্তের দেশে মিশে যায় শরৎ আর শীত। হেমন্ত এক সত্য, তবু শেষ সত্য নয়। তাকে চিনতে হলে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
তন্ময় কবিরাজ, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy