Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
বাঙালি আত্মীয়তার মরমি মন মেলে ধরেছিলেন মনোজ মিত্র
Manoj Mitra

বাঙালিয়ানার নাটককার

বাংলার বাইরের এক নামী পরিচালক কাজ করতে এসে মনোজকে বলেছিলেন, আপনার নাটকটা আমায় দিন, তার পর যা করার আমি করে নেব। মনোজ বলেছিলেন, তা হলে আমার নাটকটা থাক, নাটকটা আপনিই লিখে নিন।

বিভাস চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:০২
Share: Save:

গত শতকের পঞ্চাশের দশকের কথা। সবে বিএ পাশ করে কলেজ থেকে বেরিয়েছি। বেরিয়েই কয়েকজন সিনিয়রের পাল্লায় পড়ে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটিতে নাম লেখানো। নতুন সিনেমা নিয়ে তখন অনেকে ভাবছেন: সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, চিদানন্দ দাশগুপ্ত প্রমুখ। সত্যজিতের পথের পাঁচালী হয়ে গেছে। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার তার আগের বছরটিতে রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে এসেছেন। তারও বছর কয়েক আগে বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত ‘গণনাট্য সঙ্ঘ’-এর সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে নিজ নিজ নাট্যদলে কাজ করছেন। ‘বহুরূপী’র রক্তকরবী দেখে ফেলেছি আমরা। অজিতেশ-রুদ্রপ্রসাদরা তখনও ‘নান্দীকার’ প্রতিষ্ঠা করেননি। শ্যামল ঘোষ এক দঙ্গল যুবককে নিয়ে ‘গন্ধর্ব’-এ ব্যস্ত। বাদল সরকার বিদেশ থেকে ফিরে এসে নাটক করার কথা ভাবছেন, এখানে-ওখানে নাটক পড়ে শোনাচ্ছেন।

এমন এক সময়ে হঠাৎই একটি যুবকের নাম শোনা গেল— মনোজ মিত্র। ’৫৭-তে ‘সুন্দরম’ নামে দল তৈরি করেছেন পার্থপ্রতিম চৌধুরী ও প্রশান্ত ভট্টাচার্যের সঙ্গে মিলে। ’৫৯-এ নিজের রচিত-পরিচালিত একাঙ্ক মৃত্যুর চোখে জল নিয়ে তরুণ রায়-দীপান্বিতা রায়দের ‘থিয়েটার সেন্টার’ আয়োজিত প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছেন। ওই নাটকে অভিনয়ের জন্য তিনি নিজেও পুরস্কৃত— এক মৃত্যুপথযাত্রী অতিবৃদ্ধের ভূমিকায়। ওই সময়টায় আমরা অনেকেই অস্থির: এ দিক-ও দিক ছুটে বেড়াচ্ছি, হাতড়ে বেড়াচ্ছি, কোনটা ধরব, কোনটা ছাড়ব— নতুন থিয়েটারের আকর্ষণ, প্রবল আগ্রহ বোঝার শেখার, নতুন সিনেমা দেখার, এ-দল না ও-দলে যোগ দেব ভাবার । ’৬০-এ মনোজের সুন্দরম ছেড়ে গন্ধর্বতে যোগদান, সেখানে অনেক অল্পবয়সি কবি-সাহিত্যিক জড়ো হয়েছেন— নৃপেন সাহা, দেবকুমার ভট্টাচার্য, চিত্রশিল্পী পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়, কবি ইন্দ্রনীল, কৃষ্ণ ধর ও রাম বসু এবং নাটককার গিরিশংকর। পরিচলক শ্যামল ঘোষের খুবই প্রিয় অভিনেতা মনোজ। তাও এক বছরের মাথায় দে ছুট, আবার সেই সুন্দরমে। তিন বছর অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে বাইরে কাটিয়ে ফিরে এসেই আবার নিজের নতুন দল গড়া, ‘ঋতায়ন’।

সময়টা তখন সৃষ্টিচঞ্চল, গড়ার সময়— সবাই ছুটে বেড়াচ্ছি। ফিল্ম সোসাইটি, পাড়ায় গ্রুপ তৈরি করে থিয়েটার, কলেজে থিয়েটার, এ দিক-ও দিকে কম্পিটিশন, তার পর বহুরূপীর প্রশিক্ষণ শিবিরে ছ’মাস কাটিয়ে বেরিয়ে আসা এবং কিছু দিন পর নান্দীকারে, বছর তিনেক অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শিক্ষানবিশ থেকে চোদ্দো জনের এক সঙ্গে বেরিয়ে আসা এবং ’৬৬-তে ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’ তৈরি করা। ’৭১-এ মনোজের থেকে ওঁর চাকভাঙা মধু নাটকটি হস্তগত ও মঞ্চস্থ করা এবং ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি। ওই সময়ই ঋতায়নের পাট চুকিয়ে দিলেন মনোজ। যাবার আগে আমার হাতে তুলে দিলেন শ্যামবাজারে ১১ নম্বর পাল স্ট্রিটের কাঠগোলার উপরে ঘরটির চাবি এবং থিয়েটার ওয়ার্কশপকে ভাড়াটিয়ার স্বত্বভোগের অধিকার। ’৭৫-এ আবার ফিরে চল ভিটের টানে, সুন্দরম-এ পুনঃপ্রবেশ।

নতুন থিয়েটার, আধুনিক থিয়েটার তো করা হবে, কিন্তু যা নিয়ে করা হবে সেই নাটকের সাপ্লাই লাইনেই টান পড়ল। নাটক তো অনেক দিন থেকেই লেখা হচ্ছে, কিন্তু বিদেশি নাটক পড়ে বা দেখে যা আধুনিক নাটক বলে মনে হয়েছে সে রকম আধুনিক বা যোগ্য নাটক তেমন সংখ্যায় মিলছে কি? বাদ-ছাদ দিয়ে ক’দিন চলবে! তিন প্রধানের কথাই ধরা যাক। শম্ভু মিত্র নিজে ছাড়া মন্মথ রায়-তুলসী লাহিড়ি দিয়ে শুরু করে ইবসেন-সোফোক্লেস হয়ে রবীন্দ্রনাথ, তার পর বাদল সরকার, নীতীশ সেন-এ শেষ। উৎপল দত্ত শেক্সপিয়রকে স্টেডি রেখে নিজেই চালিয়ে খেললেন, এরই মধ্যে দেশ-বিদেশের বহু নাটককারের সঙ্গে পরিচয় করালেন আমাদের। ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’ বলতেন নিজেকে, নাটক লেখার বিষয় বা কাহিনির জন্য বেশি হাতড়াতে হত না, দেশীয় ও বিশ্ব-রাজনীতি তাঁকে অনেক অনেক আকর্ষণীয় বিষয় সাপ্লাই করে গেছে। অনেকে সহজ পথ বেছে নিলেন, আমাদের নাটকের রসভাণ্ডে কিছু ফরাসি ঘরানার রসালো ‘প্রহসন’ জমা ছিল, সেগুলির সদ্গতি করলেন। অজিতেশ প্রথমে নিজে লিখে, রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে খানিকটা ওয়ার্ম-আপ করে নিয়ে সরাসরি বিদেশি নাটকের লাগাতার অনুবাদ বা অ্যাডাপ্টেশনে চলে গেলেন। শুধু মাঝখানে কিছু দিনের জন্য বের্টোল্ট ব্রেখট নামক এক জার্মান সাহেব সবাইকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলেন। এই সময়টাতেই আবির্ভাব ঘটল তিনমূর্তির: মোহিত চট্টোপাধ্যায়, বাদল সরকার এবং মনোজ মিত্র। তিন ভিন্ন চরিত্রের নাটককার।

এই ত্রয়ীর মধ্যে মনোজ মিত্র ছিলেন খাঁটি বাঙালি ঘরানার ও সর্বসাধারণের নাটককার— পুরাণাশ্রিত কাহিনির নব-নির্মাণ থেকে আধুনিক সময়ের নাগরিক বা গ্রামীণ নিম্নবর্গীয় মানুষের কথা, গোষ্ঠী-জীবন থেকে ব্যক্তিমানুষের সুখ-দুঃখ ঈর্ষা-দ্বন্দ্ব জয়-পরাজয়ের কাহিনি, যাঁর অবাধ যাতায়াত রাজারাজড়ার দরবার থেকে মধ্যবিত্তের সংসার, ক্লাসিক্যাল গাম্ভীর্য থেকে প্রহসনের সরসতায় ও তরলতায়, জীবনমুখিতা থেকে হতাশার দমবন্ধ অন্ধকারে, প্লটের জটিল বুনোট থেকে সহজ সরল গল্পকথনের রীতিতে— মনোজে আমরা যে যার মতো করে দেশ ও মানুষের সবটুকুই খুঁজে পাই এবং আস্বাদন করতে পারি। শুধু বঙ্গবাসী কেন, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দেশের নানা প্রান্তে, এমনকি বিদেশের বহু শহরে ছড়িয়ে থাকা নাট্যপ্রেমী বাঙালির কাছে মনোজ মিত্রের গ্রহণযোগ্যতা সর্বাগ্রে এবং ঈর্ষণীয়ও বটে। শুধু বঙ্গভাষী কেন, ভারতের অন্য ভাষাভাষী নাট্যজন এবং নাট্যদর্শকদের কাছে মনোজ মিত্রের নাটকের আকর্ষণ কম নয়। তাই বহু ভারতীয় ভাষায় অনূদিত ও অভিনীত তাঁর নাটক। অনেক নাটক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্তও হয়েছে। বাংলায় নাটক শুধুমাত্র নাট্য-সংগঠন বা মঞ্চেরই প্রয়োজন মেটায় না, অনেক পার্বণে, অফিস ক্লাবে, স্কুল-কলেজে, পাড়ার অনুষ্ঠানে নাট্যাভিনয়ের চল আছে, এবং সেই ক্ষেত্রগুলিতে পছন্দের তালিকায় মনোজ মিত্রের নাটক সাধারণত পয়লা নম্বরে। তা ছাড়া মনোজ নিজে ছিলেন গ্রুপ থিয়েটারের নামী পরিচালক-অভিনেতা, তাঁর লেখা নাটক থেকে পছন্দের নাটকগুলো নিজের দলের জন্য বেছে রাখতেন।

মনোজের নাটকের কোন দিকটা আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে? বিষয়, কাহিনি, প্লট, সংলাপ, চরিত্র— কোনটা? নাটক ভাল লাগলে তার সব দিক ঠিকঠাক হয়েছে বলেই না ভাল লাগে। আলাদা করে বলব, তাঁর কিছু কিছু মঞ্চ-নির্দেশ আমার খুব পছন্দের। কখনও কখনও এগুলো নির্দেশকের জন্য তাঁর ‘ইন্টারভেনশন’ বলে মনে হয়েছে। এই বিষয়টা নিয়ে আলাদা করে লেখার ইচ্ছে আছে। যেমন শুধু তাঁর মঞ্চাভিনয়-চলচ্চিত্রাভিনয়ই একটি স্বতন্ত্র লেখার বিষয় হতে পারে। আমি যে-হেতু তাঁর ছ’টি নাটক পরিচালনা করেছি, অনেকে প্রশ্ন করেন, নির্দেশক রূপে কাজ করতে গিয়ে নাটককার মনোজ মিত্রের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী রকম দাঁড়ায়— মধুর না বিধুর? আমি বলব, সম্পর্ক মধুর বা বিধুর কোনওটাই নয়, নিতান্তই বন্ধুর। কিছু বলার থাকলে বন্ধুর মতোই বলেছি, দু’জন আলোচনা করেই নাটকটা নিয়ে যেটুকু যা করার করেছি। তবে শুনেছি, এক বার বাংলার বাইরের এক নামী পরিচালক এখানকার একটি প্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রিত পরিচালক হিসাবে কাজ করতে এসে মনোজকে বলেছিলেন, আপনার নাটকটা আমায় দিন, তার পর যা করার আমি করে নেব। শুনে মনোজ বলেছিলেন, তা হলে আমার নাটকটা থাক, নাটকটা আপনিই লিখে নিন। সে-নাটক আর দেননি মনোজ।

মনোজের নাটক-আলোচনা প্রসঙ্গে অনেকে একটা কথা বলেন, নাটকের চরিত্র সৃষ্টির ব্যাপারে বৃদ্ধদের প্রতি তাঁর একটা পক্ষপাতিত্ব কাজ করে। তাঁর সৃষ্ট তিনটি চরিত্র থেকে তা মনে হতে পারে— অতি অল্পবয়সে লেখা মৃত্যুর চোখে জল নাটকে অশীতিপর অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ, চাকভাঙা মধু-র কুচুটে খিটকেল বৃদ্ধ জটা, এবং সাজানো বাগান-এর সেই মরেও-না-মরে বাঞ্ছারাম। আসলে যারা অসহায়, সম্বলহীন, এ পৃথিবীর একটি প্রান্ত ধরে কোনও রকমে ঝুলে রয়েছে, অন্যদের চোখে যারা ‘মরে গেলে বাঁচা যায়’, কিংবা কোথায় যাব-র সেই একাকী বুড়ো যে যেতে গিয়েও থেকে যায় অন্যদের জ্বালাতে, কোথায় যাবে জানে না অথচ বেঁচে থাকার এক প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা— এমন চরিত্রের প্রতি মনোজের একটা স্বাভাবিক মানবিক টান, আত্মীয়তার মরমি মন আছে। কিন্তু আমার এও মনে হয়েছে যে, বার্ধক্য নয়, বিষয়টা হল: এরা শুধু একটা পরিবারের নয়, সভ্যতার জঞ্জাল, বর্জ্য— আসলে পরিহাস, জীবননাট্যের ক্লাউন!

মনোজ রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাইতেন। আমিই বরং একটা সময় তাঁকে রাজনীতিমুখী করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও তাঁর নাটকে তিনি একটা পৃথিবী রচনা করেছেন। আমাদের এই পৃথিবীর মতোই সেখানে তিনি ভাল মানুষ রেখেছেন, খারাপ মানুষ রেখেছেন, হিংসা-দ্বেষ, প্রেম-ভালবাসা, অপরাধ-শোষণ সবই রেখেছেন। তাঁর মুক্ত লেখনীতে কখনও তাদের ভালবেসেছেন, ঘৃণা করেছেন, অন্যায়-অবিচার দেখিয়েছেন, প্রয়োজনে শাস্তিও দিয়েছেন— এটাই এবং এখানেই তাঁর রাজনীতির প্রকাশ।

অন্য বিষয়গুলি:

Manoj Mitra Dramatist Play writer Bengali Drama
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy