Advertisement
০৪ অক্টোবর ২০২৪
রাজধানী রাজনীতি

তিনিই এখন বিরোধিতার মুখ বিজেপিও সেটা বুঝছে

রাহুল গাঁধী সে দিন আমাকে লিখতে বারণ করেছিলেন। বিগত লোকসভা নির্বাচনের আগের কথা। আর এত দিন পর মনে হচ্ছে সে কথা আপনাদের কাছে প্রকাশ করে দেওয়া যায়।

নতুন রসায়নের খোঁজ। সংসদে শীতকালীন অধিবেশন। পিটিআই

নতুন রসায়নের খোঁজ। সংসদে শীতকালীন অধিবেশন। পিটিআই

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

রাহুল গাঁধী সে দিন আমাকে লিখতে বারণ করেছিলেন। বিগত লোকসভা নির্বাচনের আগের কথা। আর এত দিন পর মনে হচ্ছে সে কথা আপনাদের কাছে প্রকাশ করে দেওয়া যায়। তুঘলক লেনে নিজের বাসভবনে খুব কম আসবাবপত্রে সজ্জিত ড্রইংরুমে বসে রাজীব-তনয় একান্তে বলেছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত লড়ে যাচ্ছি, কিন্তু এ বার মোদীকে পরাস্ত করা অসম্ভব। কেন জানেন? রাহুল তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলেন— আসলে আমরা তো বাস্তবের সঙ্গে লড়ছি না, লড়ছি এক ভয়ঙ্কর ‘হলোগ্রামের’সঙ্গে। হলোগ্রাম হল জ্যামিতিক মায়া। বাস্তব নয়, তবু এক পরাবাস্তবতাকে বাস্তবতা বলে ভ্রম হওয়া।

ভোটের আগে সাক্ষাৎকার নিচ্ছি, খুব লোভ হচ্ছে মন্তব্যটি অন দ্য রেকর্ড লিখে নেওয়ার। কিন্তু রাহুল রাজি নন। বললেন, এখন যুদ্ধ চলছে। আমি জেনারেল হয়ে যদি বলি জেতা কঠিন, তবে আমাদের কর্মীদের মনোবল ভেঙে যাবে। ভোটের আগে সেটা করব কেন?

নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আড়াই বছর অতিক্রান্ত। এখন তো মনে হচ্ছে হলোগ্রামের বানান বদলেছে। hologram হয়ে গেছে hollow gram। প্রথমে মায়া ছিন্ন ভিন্ন হচ্ছিল ধীরে গতিতে, প্রকৃতির নিয়মে। নোটবদলের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে এখন মোদী-বিরোধী রাজনৈতিক পরিসর দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে। আর এই পরিসরটির দখল নিতে বহু বিরোধী নেতা, বহু মুখ্যমন্ত্রী উৎসাহী। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল সর্বভারতীয় কংগ্রেসের কাণ্ডাির হিসাবে রাহুল দ্রুত সেই পরিসরের স্বতঃস্ফূর্ত নেতা হয়ে উঠছেন। বিজেপির বেশ কিছু নেতা চুপিচুপি আমার কাছে বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর ভুল চালে রাহুলও নেতা হয়ে গেল। সে কথা অবশ্য সামনাসামনি বলার সাহস নেই তাঁদের।

আপাতত তৃণমূল, সিপিএম, এআইডিএমকে, ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, এমনকী মায়াবতীও রাজ্য স্তরের পারস্পরিক মেরুকরণ অগ্রাহ্য করে জাতীয় স্তরে রাহুল নামক ছাতাটির নীচে এসে দাঁড়াচ্ছেন। দিল্লিতে একটানা ত্রিশ বছর ধরে সাংবাদিকতার দৌলতে রাহুল গাধীর রাজনীতি কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। রাহুলের সঙ্গে যত বার কথা হয়েছে, মনে হয়েছে ও খুব ভাল ছেলে। ভাল মানুষ, সৎ। ভারতীয় রাজনীতিতে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য যে সব সহজ ব্যাকরণ, রাহুল সে সব মেনে চলতে স্বস্তিবোধ করেন না। কিছু দিন আগে রাহুল অসমে যান। কাছাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামে নীল জিনস্, সাদা পাঞ্জাবি আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখে শ্রীহট্টবাসী এক ধুতি-পরিহিত প্রবীণ বাঙ্গালি নেতা তাঁকে বলেন, গ্রামে জিনস্ পরে এলে নেতা হবেন কী করে? ধুতি না হোক পাজামা-পাঞ্জাবি পরা তাই। রাহুল তাঁকে বলেন,আমি যা আমি তাই। আমি ঠিক যে রকম, ঠিক সে ভাবেই মানুষের কাছে আসতে চাই। গাঁধী টুপি আর ধুতি ভাল, কিন্তু সেটা জোর করে ভারতীয় রাজনীতিকদের ড্রেস কোড করার দরকারটা কী? দলের অনেক স্ট্র্যাটেজিস্টও রাহুলকে নেহরুর মতো টুপি পরিয়ে গাঁধী পরিবারের ‘লোগো’ তৈরি করতে চান। রাহুল সেই মুখোশের রাজনীতির বদলাতে চান। মোদীর এই ফানুস সৃষ্টির রাজনীতির চূড়ান্ত অ্যান্টিথিসিস হিসেবে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর উত্থান হচ্ছে।

এতদিন রাহুল গাঁধী কিছু বললে মোদী তো দূরস্থানে়, অরুণ জেটলি, বেঙ্কাইয়া নাইডুর মতো নেতারাও মন্তব্য করতেন না। বিজেপির ছোটখাটো কোনও মুখপাত্রকে দিয়ে রাহুলের অভিযোগের জবাব দেওয়া হত। সেই পরিস্থিতিতে দেখছি বিরাট পরিবর্তন। এখন তো মোদী নিজে, অমিত শাহ, রাজনাথ সিংহ, সবাই রাহুলের মন্তব্যের প্রতিবাদে মুখর। বিজেপির প্রচার ছিল, রাহুল ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা সব ‘বাবালোগ’, ছেলেমানুষ, নন-সিরিয়াস। দু’দিন দিল্লিতে রাজনীতি করেই ছুটি কাটাতে বিদেশে চলে যান। রাজনীতির চেয়েও রাহুলের বেশি উৎসাহ রেসিং গাড়ি, ব্ল্যাক চকোলেট অথবা জিমে। সংবাদমাধ্যমের একাংশের সাহায্যে বিজেপি প্রচার চলছিল, রাহুল সংসদে কত অনিয়মিত, এলেও কথা বলেন না, পিছনের সারিতে চোখ বুজে ঘুমান। মা সনিয়া রাহুলকে জোর করে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছেন। এই সব প্রচারকে এ বার রাহুল নিজেই ভোঁতা করে দিয়েছেন। এক নতুন রাহুল নিজেই পুরনো রাহুলের ভাবমূর্তির সঙ্গে লড়ে জিতে গিয়েছেন। পুরনো রাহুলের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন এক নতুন রাহুল। এই রাহুল সরব, আক্রমণাত্মক। রাহুল বরাবর খুব ‘প্রাইভেট পার্সন’, নিভৃতচারী, অনেকটা ওঁর বাবার মতোই। তাই সনিয়া যে ভাবে প্রয়োজনে বাড়ি থেকে হেঁটে জোটের স্বার্থে রামবিলাস পাসোয়ানের বাড়ি চলে যান, রাহুল সে সব কোনও দিনই করতে পারেন না। অত নাটকীয় ভাবে না হলেও অখিলেশ যাদব বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেক মধুর করে ফেলেছেন রাহুল। মমতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন তিনি। এসএমএস চালাচালি পর্যন্ত হয়। রাজনীতিতে নেতাদের নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়ন ভাল থাকাটা কিন্তু বিশেষ জরুরি।

নীতীশ কুমারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে পটনায় শপথ গ্রহণের পর দিল্লি ফেরার সময়ে মমতাকে দেখে বিমানে উঠতে গিয়েও নেমে এসেছিলেন রাহুল। বলেছিলেন, মমতার সঙ্গে দিল্লিতে দেখা করবেন। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের আগে সেই দেখা আর হয়নি। কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বোঝাপড়া হয়নি। উল্টে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট হয়েছিল। মমতা আর রাহুলের সম্পর্কের অবনতি হয় স্বাভাবিক ভাবেই। আজ মাত্র সাত মাস পরেই দেখছি রাহুল-মমতা সম্পর্ক আবার সেই অতীত রুক্ষতা দূর করে অনেক বেশি মসৃণ। আজকাল তো সংসদে রাহুল আর সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ হাস্যমুখ আর আলোচনার বহর দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। শুধু মমতা নয়, অখিলেশ থেকে ওমর আবদুল্লা, সব আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে সখ্যের জন্য যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন রাহুল। দিল্লির রাজনীতিতে এটাই দস্তুর। সেই নেহরু যুগ থেকে সংসদের সেন্ট্রাল আড্ডা থেকেই বার বার তৈরি হয়েছে ভবিষ্যৎ রাজনীতির জোট আর তার রণকৌশল। নব নব রূপে একই রাজনীতির ফল্গুধারা প্রবাহিত। রাহুল এই রাজনীতিতে তেমন দড় ছিলেন না। কিন্তু আজকাল নিজের আগেকার ‘একলা চলো’ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে দলের পাঁচমারি প্রস্তাবের ভাবনার জারক-রসে নিজেকে জারিত করছেন তিনি।

রাহুলের পাশাপাশি প্রিয়ঙ্কা গাঁধীও উত্তরপ্রদেশের ভোট প্রচারে আরও সক্রিয় ভূমিকা নেবেন, এমনটাই ভেবেছিল বিজেপি। ভেবেছিল, যদি প্রিয়ঙ্কাকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদ-প্রার্থী করা হয় তা হলেই রবার্ট বঢরার তথাকথিত সম্পত্তি কেলেঙ্কারির অভিযোগ এনে বিজেপি গাঁধী পরিবারের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানে নামবে। কিন্তু রাহুলের পাশাপাশি প্রিয়ঙ্কাকে একই গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতিতে নিয়ে আসার পক্ষে রায় দেননি সনিয়া। প্রিয়ঙ্কা প্রচারে যাবেন কিন্তু তাঁর ভূমিকা হবে সীমিত।

পঁচিশ বছর আগের একটি ঘটনা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। দিল্লির রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে এসেছিলেন সনিয়া গাঁধী। ঠাকুর দর্শনের পর মহারাজের ঘরে চা খেতে খেতে সনিয়া বলছিলেন, রাজনীতিতে রাহুল আসবেন, না কি প্রিয়ঙ্কা, সেটা ওঁরাই ঠিক করবেন, ওঁরা বড় হয়ে গিয়েছেন। প্রিয়ঙ্কা তখন মিউজিয়াম নিয়ে পড়াশুনো করছেন প্যারিসে, আর রাহুল লন্ডনে। তবে দু’জনেই নয়, একজনই যে আসবেন, এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সনিয়া। সংসদে এ বারের অধিবেশনে পুত্রকে দেখে মায়ের ঠৌঁটের কোণে নিশ্চয়ই নিশ্চিন্তির এক ঝিলিক হাসি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE