Advertisement
০৪ অক্টোবর ২০২৪
ঘোড়ার ছপটি দিয়ে গুন্ডাদের হটিয়েছিলেন সন্তোষকুমারী
R G Kar Hospital Incident

পথেই হচ্ছে নেত্রীর নির্মাণ

তিলোত্তমা যদি চিকিৎসক না হয়ে হতেন চটকলের মজুর, কি ইটভাটার শ্রমিক, তা হলে কি রাত দখল হত?

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪ ০৭:২৩
Share: Save:

পুজোর আগে দুঃস্থ-দুর্গতদের জন্য নতুন কাপড়জামা পাঠানোর ডাক আসে প্রতি বছরই। এ বারে এক বন্ধুদল বললেন, হকারের থেকে কাপড়জামা কিনুন, বন্যার্তদের জন্য দিয়ে যান, প্যাকেটের উপর লিখে দিন, ‘তিলোত্তমার বিচার চাই’। তারিফের সঙ্গে একটু কৌতুকও উঁকি মেরে গেল মনে। সব আন্দোলনের উপরেই চাপ আসে, নারী-আন্দোলনের বেলায় চাপ একেবারে বাপ হয়ে উঠতে চায়। পঞ্জাবের আন্দোলনরত কৃষকদের কেউ বলেনি, ‘কই, শ্রমিক কোডের প্রতিবাদ তো করছ না?’ কেরলের বন্যা দুর্গতদের কেউ বলেনি, ‘বুন্দেলখণ্ডের খরার জন্য কত তুলেছ হে?’ শুনলে তাঁরা হয়তো বলতেন, ‘মজুর, খরাক্রান্তের জন্য সহানুভূতি রয়েছে, কিন্তু এই উদ্যোগ তাদের জন্য নয়।’ সে কথা যুক্তিহীন, অমানবিক বলে মনে হত কি? অথচ, ‘তিলোত্তমার বিচার চাই’ বললেই ছুটে আসছে তির— ধর্মঘটী ডাক্তারদের খাবার পাঠাচ্ছ, বন্যার্তকে দিলে না যে? পুজোয় জামা না কিনলে হকারদের কী হবে?

সবাইকে না খাইয়ে মেয়েরা যেমন নিজের খাবার বাড়ে না, তেমন সকলের ন্যায়ের ব্যবস্থা না করে নিজের জন্য ন্যায়টুকুও দাবি করতে পারবে না। গলা ফাটিয়ে বলা যাবে না ‘ধর্ষকদের গ্রেফতার করো’, যদি না বন্যার্তের ত্রাণ, হকারের বিক্রি, মৃৎশিল্পীর বায়না, সরকারি হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা, সব ব্যবস্থা সেরে ফেলা যায়। এ এক অসম্ভব, যুক্তিহীন প্রত্যাশা। মেয়েরা যে নিজের প্রয়োজনকে আর কারও প্রয়োজনের আগে স্থান দিতে পারে না, সেই স্বভাব-সঙ্কোচকে মেয়েদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। ‘আমি কি নিজের জন্য ন্যায় চাইতে গিয়ে অন্যের অসুবিধে করে ফেললাম?’ এটা বৈধ প্রশ্নই নয়। এ হল সঙ্কোচের বিহ্বলতা।

আর একটা প্রশ্নকে প্রহরণের মতো ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে— তিলোত্তমা যদি চিকিৎসক না হয়ে হতেন চটকলের মজুর, কি ইটভাটার শ্রমিক, তা হলে কি রাত দখল হত? সত্যিই তো, গৃহপরিচারিকা বা মিড-ডে মিলের কর্মীরা তিলোত্তমার বিচার চেয়ে রাস্তায় নেমেছেন বটে, কিন্তু যে ‘থ্রেট কালচার’-এ তাঁদের বাস করতে হয়, তার আন্দাজ শহুরে মেয়েদের রয়েছে কতটুকু? সন্দেশখালির মেয়েরাও তো ‘রেপ কালচার’-এর বিরুদ্ধেই রাস্তায় নেমেছিলেন। দলীয় রাজনীতি তাঁদের আন্দোলনকে আত্মসাৎ করল, রুখতে পারলেন না নারীবাদীরা। নইলে সেটাই হতে পারত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম নাগরিক প্রতিবাদ।

তবু, এটাই সত্যের সবটুকু নয়। কেবল ‘মেয়ে’ পরিচয়ের জন্যই সব মেয়ে, সব সময়ে, শ্রেণি-বর্ণ-ধর্ম পরিচয়কে অতিক্রম করতে পারবে, এ-ও এক অসম্ভব প্রত্যাশা। কমিউনিস্ট আন্দোলন কি লিঙ্গবৈষম্যকে অতিক্রম করতে পেরেছে? গান্ধী স্বয়ং কি তা পেরেছিলেন? সেই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কমিউনিস্টদের, গান্ধীবাদীদের আমরা নস্যাৎ করি না। তা হলে ‘ধনী মেয়ে-গরিব মেয়ে যদি এক না হল, তা হলে আর কী হল’ বলে হা-হুতাশ করা কেন? সাম্যের পথ দীর্ঘ, পিচ্ছিল। বরং লক্ষ করা দরকার যে, রাত দখলের স্লোগান, কর্মসূচি, সংগঠন দেখে মালুম হয়, এর সংগঠকরা কেবল গোটাকতক ধর্ষককে হাজতে ভরতে চান না। ধর্ষক জোগানের যে কারখানাটি চালাচ্ছে রাষ্ট্র, তাকে পিষে দিতে চান। সেই দাবি ইতিমধ্যেই শহর-গ্রামে এক দলহীন মঞ্চ তৈরি করেছে। যে কোনও শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, বা রাজনৈতিক মতাদর্শের মেয়েরা সেখানে পা রাখতে পারছেন। এই মেরুকরণের দিনে এ কি কম কথা? প্রশ্ন কেবল এই যে, একে কত দিন দলীয় রাজনীতির থাবা থেকে রক্ষা করা যাবে। ইতিহাস দেখিয়েছে, কিছু মেয়ে কত পরিশ্রমে ধনী-গরিবের দুস্তর বাধা পার করেছেন, আর তার পর দলীয় রাজনীতি খারিজ করেছে তাঁদের সযত্ন-রচিত সংযোগকে।

তেমন এক জনের কথা, এই পুজোর আগে, মনের দরজায় কড়া নেড়ে চলেছে। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে এক সাতাশ বছরের তরুণী প্রকাশ করেছিলেন একটি পত্রিকা, নাম শ্রমিক। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, তিনটে ভাষাতেই বার হত, দাম ছিল এক পয়সা। পুজোসংখ্যা দিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল (২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৪)। সম্পাদক সন্তোষকুমারী দেবী (১৮৯৭-১৯৮৯) সেই সংখ্যায় একটা কবিতা লেখেন, যার পঙ্‌ক্তি, “ধনীর ভ্রুকুটি অঙ্গভূষণ, লাঞ্ছনা যার পারিশ্রমিক/ ভোগ-সমুদ্র মন্থন-বিষ যাহার ভাগ্যে সেই না শ্রমিক?” লাঞ্ছনা অবশ্য সম্পাদকেরও কম হয়নি— ছাপাখানার বিল মেটাতে গিয়ে নিজের নেকলেস বাঁধা রাখতে হয়েছিল বারো হাজার টাকায়। জানতে পেরে তা ছাড়িয়ে এনেছিলেন বিধানচন্দ্র রায়।

উদারতা ঠিক নয়, এ ছিল বিধানচন্দ্রের প্রতিদান। মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশের অনুগামী ছিলেন সন্তোষকুমারী। ১৯২৩-এ চিত্তরঞ্জন অনুরোধ করেন, তাঁর দলের হয়ে ব্যারাকপুর থেকে বেঙ্গল কাউন্সিল নির্বাচনে দাঁড়ানো প্রার্থীর জন্য প্রচার করতে। সেই প্রার্থী ছিলেন বিধানচন্দ্র। তাঁর বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন কংগ্রেসের ‘গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান’ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্যারাকপুরের শ্রমজীবীদের মধ্যে তখন সন্তোষকুমারীর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তাঁর নেতৃত্বে সে বছরই গৌরীপুর চটকলে তিন মাসের ধর্মঘট সফল হয়েছে, শ্রমিকদের প্রায় সব দাবি মেনে চটকল খুলেছে। সন্তোষকুমারী হয়ে উঠেছেন অবিসংবাদিত শ্রমিকনেত্রী। হিন্দি ও উর্দুভাষী অবাঙালি শ্রমিকরা তাঁকে ডাকতেন ‘মাইরম’। সে বার নবাগত বিধানচন্দ্রের কাছে পরাজয় হল সুরেন্দ্রনাথের। সন্তোষকুমারীর স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়, নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন এক দিন সুরেন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, সন্তোষকুমারীর ভাষণই বিধান রায়কে জিতিয়ে দিচ্ছে।

কৃষিজীবী-শ্রমজীবীর সমস্যাকে কংগ্রেস দেখত মানবিক সঙ্কটের দৃষ্টিতে, সন্তোষকুমারী তা তুলে ধরেন সমানাধিকার, সামাজিক অন্যায়ের নিরিখে। ন্যায্য মজুরির দাবিকে রাজনৈতিক আন্দোলনে নিয়ে আসতে চান, তা শ্রমিকসংহতি পত্রিকায় তাঁর লেখাগুলি থেকেই বোঝা যায়। তবে কংগ্রেস বা স্বরাজ্য দল শ্রমিকদের কথা মুখে বললেও (চিত্তরঞ্জন বলেছিলেন, স্বরাজ মানে ৯৮ শতাংশের স্বরাজ), কাজে তেমন কিছু করেনি। সন্তোষকুমারী শ্রমিক মেয়েদের ক্লিনিক, প্রাথমিক স্কুল খোলার মতো নানা কাজ করেছিলেন তাঁর সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবনে (১৯২৩-২৭)। মনে দাগ কেটে যায় তাঁর ব্যক্তিত্বও। সন্তোষকুমারী হগ মার্কেট (এখন নিউ মার্কেট) কর্মীদের সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, বন্দর শ্রমিকদের সভায় চার্লস টেগার্টের ধমক অগ্রাহ্য করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, ঘোড়ার গাড়ির ছপটি দিয়ে চটকল মালিকের পোষা গুন্ডাদের পিটিয়েছিলেন।

এমন কত শ্রমিক নেত্রী, কৃষক নেত্রী বাংলার মেয়েদের উত্তরাধিকার। ভারতের নারী-আন্দোলন সব মেয়ের জন্য ভোটাধিকার, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব, যথাযথ মজুরির জন্য লড়াই করে এসেছে, একেবারে প্রথম যুগ থেকেই। আদিবাসী মেয়ে মথুরা বা দলিত মেয়ে ভাঁওরীর ধর্ষণের প্রতিবাদে গোটা দেশের মেয়েরা যে আন্দোলন করেছিলেন, তার জেরেই নতুন আইন এসেছে। জাত-ধর্ম-শ্রেণি সংঘাত সত্ত্বেও মেয়েতে-মেয়েতে সেই সংযোগ কখনও ছিন্ন হয়নি।

তবে গত দু’তিন দশকে নারী-অধিকার ক্রমে ‘এনজিও’-দের বিষয় হয়ে ওঠায়, এবং সরকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হওয়ায়, নারীবাদী আন্দোলনের ধার হয়তো কমেছিল। রাষ্ট্রশক্তির বিপরীতে দাঁড়ানোর সময় যখন এল, তখন ডাক দিল অনুদানহীন ছোটখাটো সংস্থা, ছাত্রছাত্রীরা, প্রাক্তনীদের সংগঠন, খেলার ক্লাব, নাট্যদল, পত্রপত্রিকা, এবং অগণিত ব্যক্তি। আন্দোলনই নির্মাণ করে নিল তার নেতাদের। সম্প্রতি এক সভায় ‘বিচার চাই’ আন্দোলনের কিছু উদ্যোক্তা এসেছিলেন। পরিচয় পর্বে প্রায় সকলেই বলছিলেন, “আমি অমুক সংগঠনের পক্ষ থেকে আসছি।” এক তরুণী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি আমার বাড়ি থেকে আসছি, নিজের পক্ষ থেকে কথা বলব।” এ-ও নারীবাদের কণ্ঠস্বর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

R G Kar Hospital R G Kar Protest Doctor's Protest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE