রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবত সম্প্রতি এক জনসভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন: ইংল্যান্ডের অধিবাসীদের যদি ইংরেজ বলা হয় কিংবা জার্মানির অধিবাসীদের জার্মান, তা হলে হিন্দুস্থানের লোকেরাই বা হিন্দু নন কেন? যুক্তিসম্মত জিজ্ঞাস্য, কিন্তু উত্তর দিতে গিয়ে কেউই যুক্তিপথে হাঁটলেন না। কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি থেকে সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি থেকে বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী, সকলে জানালেন, সংবিধানে হিন্দুস্থান নামটি নেই। ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত বলা আছে। ভাগবত বরং আগে দেশের সংবিধানটি ভাল করে পড়ুন! তপ্তমস্তিষ্ক রাজনীতিকরা খেয়াল করলেন না, সংবিধানের বাইরে জনসমাজে হিন্দুস্থান নামটি যথেষ্ট প্রচলিত। অজয় দেবগণের ‘হিন্দুস্থান কি কসম’, কমল হাসানের ‘হিন্দুস্থানি’, মায় আমির খান-করিশমা কপূরের ‘রাজা হিন্দুস্থানি’... আরও কত নাম অনায়াসে আউড়ে দেওয়া যায়।
রাজনৈতিক বিতর্কে সিনেমার নামগান চলবে না, প্রত্যাশিত। কিন্তু ইকবালের ‘সারে জহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্থান হমারা’? কেউ খেয়াল করলেন না, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধের বাইরে বেরিয়ে এসে ভাগবত পাকিস্তানের জাতীয় কবি মহম্মদ ইকবালকে সাদর স্বীকৃতি দিলেন। এখানেই তো ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদের গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর দেশপ্রেম! এত বড় মাপের প্রেম নরেন্দ্র মোদীর সইবে তো?
সে যা-ই হোক, মানতেই হবে, এক প্রশ্নে ইতিহাসের অনেক ভুল শুধরে দিয়েছেন ভাগবত। মুঘল সম্রাট আকবর এক বার জেসুইট পাদরিদের থেকে বাইবেল বুঝলেন, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হলেন। অত্যুৎসাহী পাদরিরা রোমে খবর পাঠিয়ে দিলেন, হিন্দুস্থানের বাদশা ঈশ্বরপুত্র প্রবর্তিত ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কয়েক দিন বাদে তাঁরা মসজিদে সম্রাটকে নমাজ পড়তে দেখে তাজ্জব, ‘কী আশ্চর্য! আপনি সে দিন খ্রিস্টান হলেন যে!’ আকবরের উত্তর: ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি মুসলমানও।’ মোহন ভাগবত ৫০০ বছর আগে জন্মালে পাদরিরা পোপকে ভুলভাল খবর পাঠাতেন না। হিন্দুস্থানের বাদশা খ্রিস্টান হবেন কী ভাবে? তিনি অবধারিত হিন্দু হবেন!
হিন্দুস্থানের বাসিন্দা অর্থে হিন্দু শব্দটিতে আকবর মোটেও আপত্তি করতেন না। তাঁর সভাসদ আবুল ফজল যে ‘আইন ই আকবরী’ লিখেছিলেন, সেটি মধ্যযুগের টাইম স্পেস কন্টিনিউয়ামের বাইরে অন্য ধারণা। সুলতানদের পরিচয় জানাতে তখন গ্রন্থের প্রথমে আল্লার নাম, তার পর হজরত মহম্মদ, খলিফাদের নাম, সেখান থেকে সুলতানের পূর্বপুরুষ ও সুলতানে আসাই রীতি। আবুল ফজল এই রীতি ভাঙলেন। শুরুতে আল্লার নাম করলেন বটে, কিন্তু তার পর সটান প্রথম মানব আদমের জয়গান। আদমের ৫৩-তম পুরুষই তো সম্রাট আকবর স্বয়ং! ইসলামিক ইতিহাসের বাইরে হিন্দুস্থানের এই নিজস্ব দৃষ্টিকে হিন্দু বলতে আপত্তি কীসের? বস্তুত, মুঘল যুগের বহু আগে, সুলতানি আমল থেকে এই ঘরানা চলে আসছে। নিজামুদ্দিন আউলিয়া, খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তি বা তাঁদের মতো সুফিসাধকরা কোনও দিন মক্কায় যেতেন না। নিজামুদ্দিন এক দিন যমুনার ধারে বসে তাঁর হিন্দু ভক্তদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁর শিষ্য আমির খসরু দেখা করতে এলেন। সুফিসাধক বললেন, নদী পেরিয়ে কত লোক এখানে আসছে দেখেছ? হর কওম রাত হ্যায়... প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ধর্ম আছে, আছে নিজস্ব ধর্মস্থান। শ্রীভাগবত দেশবাসীর ধন্যবদার্হ। তিনি একটি ছোট্ট প্রশ্নে নিজামুদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরু থেকে আকবর সকলের কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছেন।
অনেকে অহেতুক কূটতর্ক খুঁজতে পারেন। হিন্দুস্থানের অধিবাসীদের হিন্দু না বলে হিন্দুস্থানি বললেই হত। কিন্তু দু’একটা কথা ভেবে দেখুন। প্রথমত, হিন্দুস্থানি মানে উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্যের হিন্দিভাষী বাসিন্দা। দ্বিতীয়ত, সুরিনাম, মালদ্বীপ, মরিশাসে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া দক্ষিণ এশীয়মাত্রই হিন্দুস্থানি। তৃতীয়ত, দেশভাগের সময় করাচি, হায়দরাবাদ শহরে যে উর্দুভাষী ভারতীয় উদ্বাস্তুরা আশ্রয় নিয়েছিলেন, পাকিস্তানে তাঁদের সাধারণ নাম: হিন্দুস্থানি। ‘হিন্দুস্থানের হিন্দু’ কথাটিতে তাই আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আছে, এর সঙ্গে হন্ডুরাসে হাহাকার বা সাহারায় শিহরনকে গোলালে মোটেই চলবে না। হিন্দুস্থানে থাকলে হিন্দু, আর বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে কথাই নেই। আরও বড় হিন্দু! মোহন ভাগবত একটি প্রশ্নেই দীননাথ বাত্রাদের সমুচিত শিক্ষাদান করেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘বারাণসী: সেক্রেড লাইট’ বইয়ের লেখিকা ডায়ানা এক্ থেকে ‘হিন্দুইজম: অল্টারনেট হিস্ট্রি’র ওয়েন্ডি ডনিগার হিন্দুধর্মের কী বোঝেন গোছের অর্বাচীন প্রশ্ন তিনি সহ্য করবেন না। বাত্রাজি অবশ্য এতে খুবই বিমর্ষ বোধ করতে পারেন।
মোহন ভাগবত আরএসএসে অদৃষ্টপূর্ব এক হঠাৎ আলোর ঝলকানি। গ্রিক হেরোডোটাস বা মেগাস্থেনিস কথিত ‘ইন্ডিয়া’ নয়, বিষ্ণুপুরাণের ‘ভারতবর্ষ’ বা মহাভারতের ‘জম্বুদ্বীপ’ নয়, গজনির সুলতান মাহমুদের সঙ্গে ভারতে আসা ইসলামি দার্শনিক আল বিরুনির লেখা নামটিই তিনি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন। পারসিকরা সিন্ধু নদকে হিন্দু বলত, সেখান থেকে আল বিরুনি, মাসুদিদের আরবি ভাষায় ঢুকে পড়ল ওই নাম। হিন্দুরা আফগানিস্থানের যে দুর্গম গিরিপথে মারা যায়, তারই নাম হিন্দু কোহ। পরে উচ্চারণ বদলাতে বদলাতে হিন্দুকুশ। মোহন ভাগবত আর এস এসের সেই দুর্লভ উদার দৃষ্টি, যিনি ক্ষুদ্র হিন্দুত্বের গণ্ডি ছেড়ে এসে আল বিরুনিকে যথাযথ শ্রদ্ধা জানালেন। সপরিবার আরএসএস এই নতুন উদারতার ঠেলা সামলাতে পারবে কি না, সেটা অবশ্য অন্য কথা।
একটাই খটকা। মোহন ভাগবত নিজে, মায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রচারক হিসেবে সঙ্ঘজীবন শুরু করেছিলেন। জার্মানির জার্মান বা ফ্রান্সের ফরাসি জাতির প্রচারক নেই। তা হলে হিন্দুস্থানের হিন্দুদের ওটি লাগবে কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy