ভীম আর্মি প্রধান চন্দ্রশেখর আজ়াদ দলিত সভায় ভাষণ দিচ্ছেন, গাঁধী ময়দান, পটনা, ২১ নভেম্বর। পিটিআই
চ ন্দ্রশেখর আজ়াদ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন, অযোধ্যায় রবিবারের ‘তামাশা’টা হয়ে গেলে সোমবার সেখানকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অনিল কুমারের কাছে যাবেন। হাতে নেবেন ভারতীয় সংবিধানের একটা কপি। মনে করিয়ে দেবেন, দেশটা এখনও ‘রামরাজ্য’ হয়ে যায়নি, এখনও এটা সংবিধানশাসিত গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে লাখ লাখ লোককে এ ভাবে খেপানো যায় না। কথাটা আগেও তুলেছিলেন তিনি। জেলাশাসক নাকি তখন বলেছিলেন, কী করব, লোক যদি আসতে চায়, তাদের আটকাব কী করে। চন্দ্রশেখর আজ়াদের উত্তর: আটকাবেন কী করে সে তাঁদেরই ভাবতে হবে; প্রশাসন চালাবেন, অথচ দায়িত্ব নেবেন না, এ তো হয় না। পরে আর একটা লাইন যোগ করলেন তিনি: আটকাতে না পারলে পদত্যাগ করুন নেতারা— মুখ্যমন্ত্রী যোগী এবং প্রধানমন্ত্রী মোদী— ‘‘আমরা গ্রহণ করব তাঁদের পদত্যাগপত্র।’’ ৬ ডিসেম্বর নাগাদ আবার রামভক্তরা পথে নামবেন, রথ যাত্রা শুরু হচ্ছে সে সময়ে। আজ়াদ মনে করিয়ে দিলেন, ৬ ডিসেম্বর দলিতদের কাছে একটা পবিত্র দিন, মহাপরিনির্বাণ দিবস— বাবাসাহেব অম্বেডকরের মৃত্যুদিন। ‘‘যাতে বাবাসাহেবকে সবাই ভুলে যায় তার জন্যই ১৯৯২ সালে দিনটাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য’’, আজ়াদের অভিযোগ। ‘‘এ বারও তাই।’’
কে এই আজ়াদ? উত্তরপ্রদেশের দলিত সংগঠন ভীম আর্মি ফাউন্ডেশন-এর নেতা। মায়াবতী বার বার তাঁকে নানা ছুতোনাতায় অপমান করা সত্ত্বেও সামনের জাতীয় নির্বাচনে আজ়াদ তাঁকেই নেত্রী মেনেছেন, আর কংগ্রেসকে অনুরোধ করেছেন মায়াবতীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার জন্য। প্রবল উদ্দীপনাময় তরুণ নেতা কী বলেন মায়াবতীর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বিষয়ে? বলেন যে, তাঁর দল রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়, আর মায়াবতী দলিতদের রাজনীতির প্রধান মুখ। ফলত আজ়াদের দিক থেকে তাঁকে সমর্থন না করার প্রশ্নই ওঠে না। প্রসঙ্গত, কিছু দিন আগেই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন আজ়াদ। বছরখানেক আগে সাহারানপুরের কাছে যে রাজপুত বনাম দলিত সংঘর্ষ হয়েছিল, তাতে নেতৃত্বদানের দায়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অর্থাৎ দলিত-উচ্চবর্ণ লড়াই থেকেই তাঁর উত্থান। কথাটা গুরুতর, বিশেষ করে বিজেপির পক্ষে।
বিনীত মৌর্যের নামটা এ বারের অযোধ্যাকাণ্ডের পরই মনে করিয়ে দিয়েছেন আজ়াদ। বিনীতের করা একটা মামলা মার্চ মাস থেকে সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে আছে। অযোধ্যার বিতর্কিত জমিটির উপর বৌদ্ধ দাবি যে বিরাট, খননকার্যের ফলে তেমন তথ্যপ্রমাণ মিলেছে অনেক। সুতরাং আজ়াদের বক্তব্য: মন্দির-মসজিদ ঝামেলার বাইরে গিয়ে অযোধ্যার প্রাচীন বৌদ্ধ নাম ‘সাকেত’কে ফিরিয়ে আনা হোক, একে বৌদ্ধ তীর্থস্থান হিসেবে ঘোষণা করা হোক। দলিত নেতার এই বৌদ্ধ সংযোগ উত্তরপ্রদেশে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই তো কিছু কাল আগেই খবর এল, অক্টোবরে উত্তরপ্রদেশের কানপুরের কাছে পুখরায়ন গ্রামে সার বেঁধে ১০০০০ দলিত বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। তার আগে ২০১৭ সালের জুন মাসে মুজফ্ফরপুরের নায়ামু গ্রামের ২০০০ দলিত অধিবাসীর প্রত্যেকে বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। কেন? একটিমাত্র শব্দেই এর উত্তর সম্ভব: ঠাকুর। ঠাকুর গোষ্ঠীর অত্যাচার থেকে বাঁচতেই এই ‘মাস-স্কেল’ ধর্মান্তরণ। ‘বৌদ্ধ’ হলে এঁরা একটি করে সার্টিফিকেট পান, সেটাকে যত্ন করে রাখতে হয়। ২০১৭-রই মে মাসে সাবিরপুর গ্রামে ঠাকুর-দলিত দাঙ্গা বেঁধেছিল, তাতে হতাহত হয়েছিলেন বেশ কিছু। প্রতিবাদে চন্দ্রশেখর আজ়াদ (যাঁর চলতি নাম ‘রাবণ’) সভা ডেকেছিলেন সাহারানপুরে, গ্রেফতারও হয়েছিলেন, যে কথা একটু আগেই বললাম। এই ‘রাবণ’-এর মুক্তি চেয়ে দলে দলে বিক্ষুব্ধ দলিত বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন সেই সময়ে।— কাহিনিটি অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি না স্মরণ করি, এই দলিতদের পূজ্য দেবতা রামের মহাশত্রু রাবণ। নেতা রাবণের সঙ্গে আরাধ্য রাবণের সংযোগটার মধ্যে অযোধ্যার দলিত সংস্কৃতির অনেকটাই ধরা পড়ে। বোঝা যায়, অযোধ্যা কেবল রামভক্তদের নয়, রাবণভক্তদেরও জায়গা! এখন দুই শিবিরে যে সংঘর্ষ চলছে, তাকে লঙ্কাকাণ্ড বললে ভুল হবে না।
আর একটি নাম এই সূত্রে: বালজিভাই রাঠৌর। কয়েক মাস আগে ইনি গুজরাতের সুরেন্দ্রনগর জেলায় থঙ্গর শহরে পরিবারসুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। ইনি এবং এঁর পরিজন অনেক নির্যাতন সয়েছেন যত দিন দলিত পরিচয় ছিল। উনা শহরকে নিশ্চয়ই মনে আছে— সেই তিন দলিত যুবকের গণপ্রহারে মৃত্যু? উনাকে কেন্দ্র করে তখন কেবল দাঙ্গার আগুনই জ্বলেনি, তার পর থেকে নিয়মিত দলিত ধর্মান্তরণ চলছে ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে। ২০১৬ সালে উনা সংঘর্ষের দুই মাসের মধ্যে সেখানে একটি বৌদ্ধ বিহার তৈরি করেন স্থানীয় দলিতরা। স্থানীয় বিজেপি প্রশাসনের উপর এঁরা বেজায় ক্ষিপ্ত— দলিতদের উপর অত্যাচারের কোনও তদন্তই সেখানে শেষ হয় না, কোনও অপরাধীই শাস্তি পায় না। কেবল গুজরাত নয়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশেও দলিতদের কাছে উনা এখন এক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে— অনেক দিনের ব্রাহ্মণ্য নির্যাতনের চরম বিন্দু যাকে বলে। এর মধ্যে রামমন্দির? গুজরাতে আমদাবাদের দানিলিমদা দলিতরা বলেই দিয়েছেন, রামমন্দিরের পুরোহিতদের মধ্যে দলিত কাউকে রাখলে তবে তাঁরা ‘ভেবে দেখবেন’।
এ সব কিছু নতুন কথা নয়। দলিত ও বর্ণহিন্দু সংঘর্ষের সূত্রে তবে মনে করা যাক সেই মহানাম— দেশময় গোটা দলিত সমাজের কাছে যিনি দেবতার মতো। জীবনের শেষ বছরটিতে বাবাসাহেব অম্বেডকর নিজেই বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। সঙ্গে নিয়েছিলেন আরও লাখখানেক দলিতকে। দিনটা ছিল ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর। আর স্থান? নাগপুর! সেই নাগপুর, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মহাপীঠ। কেন হঠাৎ নাগপুর? কেউ কেউ অনুমান করেছিলেন, আরএসএস কেন্দ্রে ধর্মান্তরণের আয়োজন করে অম্বেডকর একটা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। নাঃ, অত সহজে বাবাসাহেবকে বোঝা যাবে না। তিনি ব্যক্তিত্বগুণে এই সব তুচ্ছ দেখানেপনার ওপরে ছিলেন। তাঁর ভাষায়, মানুষের জীবনে এত অতিরিক্ত সময় কি আছে যে নিজের ভাবনাচিন্তা খরচ করে অন্যকে একটা ‘বার্তা’ দেওয়া হবে! তাই নাগপুরকে বেছে নেওয়ার কারণটা অন্য। ধর্মান্তরণের পর দিন একটি বক্তৃতায় অম্বেডকর মনে করিয়েছিলেন, প্রাচীন কালে নাগ জাতির অধিবাস ছিল এই জায়গায়। নাগরা ছিলেন আর্য জাতির চরম শত্রু (‘ফিয়ারফুল এনিমিজ়’), আর্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে অবশেষে তাঁরা সকলে মিলে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রসারের পিছনে নাগ জাতির অবদান বিরাট। (এ সব শুনে অবশ্য আরএসএস প্রচারকদেরই হতাশায় ভেঙে পড়া উচিত নিজেদের অবোধ স্থান নির্বাচন নিয়ে!)
এখনও ‘আর্য’দের বিরুদ্ধে ‘নাগ’রা যে একই রকম ফুঁসছে, চন্দ্রশেখর আজ়াদের কথায় তার প্রমাণ। এই দলিত মানুষটি নাকি জেলে থাকার সময় নমাজ পড়তেন নিয়ম করে। তা, এক সময় তাঁকে জেলার প্রশ্ন করেন, তিনি কি ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন? চন্দ্রশেখর বললেন, সারা জীবন মন্দিরে ঘণ্টা বাজিয়েও মন্দিরে ঢুকতে পারেননি তিনি, অর্থাৎ হিন্দুই হতে পারেননি! হিন্দু না হলে আর ধর্মান্তরণ করে মুসলিমই বা হবেন কী করে?
আসলে, ভোট কাছে এলে কেবল রামমন্দিরের খোঁজ পড়ে না, দলিতদের খোঁজটাও কেবল তখনই পড়ে। বিজেপি নেতারা জানেন না, জানবেনও না যে ঠিক এটাই বলে দিয়েছিলেন দলিত আইকন, সংবিধানপ্রণেতা বাবাসাহেব। সংবিধানসভার শেষ বক্তৃতায় পর পর তিনটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন তিনি। তার একটি ছিল গণতন্ত্র বিষয়ক। ভারতে যে কোনও কালে গণতন্ত্র ছিল না, তা তো নয়, বৌদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘগুলোতেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও আচরণ অনুযায়ী আলোচনা হত, বলেছিলেন তিনি। মোশন, রেজ়লিউশন, কোরাম, হুইপ— প্রতিটির প্রচলন ছিল সেখানে। তার পর কালক্রমে ভারত তা হারিয়েছে। আবারও কি গণতন্ত্র হারাবে ভারত? ভারতীয় মাটির একটা কোনও সমস্যা আছে, মনে হয়েছিল তাঁর। এখানে কী করে যেন গণতন্ত্র থেকেই জন্মায় ডিকটেটরশিপ, একচ্ছত্র কর্তৃত্ববাদ। সংবিধান প্রণয়ন করার পরই তাই অম্বেডকরের মনে হয়েছিল, এই ভবিতব্যই হয়তো দেশের কপালে নাচছে!
এই কথাটির সূত্রে আমরাও অনুমান করতে পারি— প্রাচীন কালের নাগজাতি, আধুনিক কালের অম্বেডকর, এবং সাম্প্রতিক আধুনিকের চন্দ্রশেখররা— এঁদের যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি এমন টান, সেটা হয়তো কেবল ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিবাদই নয়; হয়তো একটা সুস্থতর গণতন্ত্রের সন্ধানও বটে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy