Advertisement
১২ ডিসেম্বর ২০২৪
Uma Dasgupta

সম্পাদক সমীপেষু: সত্যজিতের দুর্গা

কলস বা ভস্মাধারের গায়ে খোদিত একটি দৃশ্যে এক প্রেমিক তার প্রেয়সীকে অনুসরণ করছে। অন্য একটি দৃশ্যে সবুজ গাছের নীচে বংশীবাদকেরা বাঁশি বাজিয়ে গান গাইছে।

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৫১
Share: Save:

‘যে দুর্গার নিরঞ্জন হয় না’ (১৯-১১) সংবাদ প্রসঙ্গে কিছু কথা। ইংরেজি অনার্সের তৃতীয় বর্ষে জন কিটসের বিখ্যাত কবিতা ‘ওড অন আ গ্ৰেসিয়ান আর্ন’ পড়েছিলাম। কবিতাটিতে কবি একটি প্রাচীন গ্ৰিক কলস বা ভস্মাধারকে সম্বোধন করে এর গায়ে খোদাই করা নানা রকম চিত্রের নৈসর্গিক ও চিরন্তন রূপ বর্ণনা করেছেন। কলস বা ভস্মাধারের গায়ে খোদিত একটি দৃশ্যে এক প্রেমিক তার প্রেয়সীকে অনুসরণ করছে। অন্য একটি দৃশ্যে সবুজ গাছের নীচে বংশীবাদকেরা বাঁশি বাজিয়ে গান গাইছে। আর একটিতে গ্ৰামবাসী ও এক জন পুরোহিত একটি বলিদান অনুষ্ঠানে সমবেত হচ্ছে। কলসের গায়ে চিত্রিত দৃশ্যে প্রেমকাতর প্রেমিক তার প্রেয়সীকে চিরকাল অনুসরণ করতে থাকবে। সময়ের নিষ্ঠুরতা কোনও দিন সবুজ গাছের পাতা ঝরিয়ে তাকে নগ্ন করতে পারবে না। বংশীবাদকেরা গান গেয়ে চিরকাল মানুষের সুখ-দুঃখের অনুসারী হবে। এবং বলিদান অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা মানুষদের গ্ৰামখানি ও তার রাস্তা-ঘাট চিরকাল জনশূন্য ও নীরব থাকবে, কারণ তারা আর কখনও গ্ৰামে ফিরে যাবে না। কলসের গায়ে চিত্রিত ছবিগুলো শৈল্পিক ও নান্দনিক, তা অমর, অক্ষয় ও অবিনশ্বর। সর্বগ্ৰাসী সময়ের ভ্রুকুটি, রুক্ষতা ও হিংস্রতা তাদের কোনও দিন স্পর্শ করতে পারবে না।

কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁর অমর সৃষ্টি পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রে অপু-দুর্গার যে চরিত্র চিত্রায়িত করেছেন, তা চিরন্তন ও কালজয়ী। গ্ৰামের আটপৌরে শাড়িতে দুর্গা, ভাই অপুর হাত ধরে কাশবনে ছোটাছুটি করে, দুই ভাই-বোন রেল লাইনের ধার দিয়ে দৌড়য়, দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন দেখতে যায়। এ সব দৃশ্য বিষাক্ত কালের ছোবলে কোনও দিন বিবর্ণ বা মলিন হবে না। বরং দৃশ্যগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষের মনে জীবন্ত থাকবে। ‘ওড অন আ গ্ৰেসিয়ান আর্ন’-এর মতো মানুষকে শেখাবে ‘বিউটি ইজ় ট্রুথ, ট্রুথ বিউটি’।

কালের নিয়মে প্রকৃতি ও নর-নারীর অপরূপ সৌন্দর্য যেমন বিবর্ণ হতে হতে এক দিন নিঃশেষ হয়ে যায়, তেমনই বাস্তবের দুর্গা যাদবপুর বিদ্যাপীঠের শিক্ষয়িত্রী উমা দাশগুপ্ত (বিয়ের পরে সেন) ৮৪ বছর বয়সে চলে গেলেন মৃত্যুলোকে। রেখে গেলেন ‘অপু’ সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় ও ‘ছোট দুর্গা’ শম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি দুর্গার বয়স বাড়ে না। সে চিরকাল প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর এক কিশোরী। সত্যিই এ দুর্গার বিসর্জন হয় না।

হারান চন্দ্র মণ্ডল, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

করুণরস

‘যে দুর্গার নিরঞ্জন হয় না’ শীর্ষক সংবাদটি বাংলার চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের মনকে ভারাক্রান্ত করে দিয়ে গেল। চলে গেলেন পথের পাঁচালী-র দুর্গা। রেখে গেলেন বাংলার মানুষের মনে একরাশ স্মৃতিকথা। সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণ সৃষ্টি ‘আম আঁটির ভেঁপু’র চলচ্চিত্রায়নপথের পাঁচালী শুধুমাত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়কেই বিশেষিত করেনি, পরিচিত করেছে বাংলা চলচ্চিত্রকেও।

দুর্গার চরিত্রাভিনেত্রীকে পরবর্তী কালে আর কোনও চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি। অথচ, তাঁর সামনে সিনেমায় অভিনয়ের অনেকটা জায়গা উন্মুক্ত ছিল। তিনি পরবর্তী কালে অনেক ছবিতে অভিনয় করতে পারতেন, যেমনটি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার অন্য অনেক শিল্পী করেছেন। কিন্তু ‘দুর্গা’র ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। তাই হয়তো আমাদের মনে দুর্গা সেই পঞ্চাশের দশকের কিশোরীটিই। তার বয়স বাড়েনি। দুর্গা সত্যজিৎ রায়ের এক অসাধারণ আবিষ্কার। ছবিতে দুর্গা সংলাপ বলেছে, আবার অনেক সময়ে নীরব থেকেছে। তখন তার চোখ-মুখ শব্দহীন কথা বলেছে। দুর্গার এই নীরব অভিব্যক্তির ছবি ছড়িয়ে রয়েছে কাশবনে রেলগাড়ি দেখায়, মিষ্টির হাঁড়ি বাঁকে নিয়ে চিনিবাস ময়রার পিছন পিছন চলায়। দুর্গার সূত্র ধরেই পথের পাঁচালী-র অনেক দৃশ্যের মধ্যে দু’টি দৃশ্য দর্শকদের মন বেদনায় ভরে ওঠে।

প্রথমটি, দুর্গা মারা গেছে। হরিহর তখন ভিন দেশে। কাজ শেষে ফিরে এসেছে, সঙ্গে এনেছে সাংসারিক কিছু জিনিসপত্র আর কাপড়জামা। মেয়ের মৃত্যুসংবাদ তখনও সে জানে না। ঝড়জলে বিধ্বস্ত বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে দুর্গাকে ডাকাডাকি করতে করতে তার জন্য আনা কাপড়টি তুলে দেয় স্ত্রী সর্বজয়ার হাতে। দুর্গা নেই, এই কথাটা মা সর্বজয়া মুখে বলতে পারল না। শুধু দু’হাতে কাপড়টা বুকে চেপে ধরে আকুল হল। এই কথাহীন দৃশ্যই যেন চিৎকার করে হাজারও কথা বলে দেয়।

ওই ছবিরই আর একটি দৃশ্যের আগের ঘটনা এই রকম। সর্বজয়ার বাড়ির উঠোনে ‘সেজোখুড়ি’ এসে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে দুর্গার বয়সি দু’টি মেয়ে, দুর্গার বন্ধু। অভিযোগ, দুর্গা তার বন্ধু টুনির পুঁতির মালা চুরি করেছে। এ জন্য সেজোখুড়ি দুর্গার বাক্স তল্লাশি করে, দুর্গাকে চোর সাব্যস্ত করে সর্বজয়াকে একশো কথা শুনিয়ে যায়। পরে অপমানিতা সর্বজয়া দুর্গাকে ভীষণ মারধর করে। এর পর যেটা মনে দাগ কাটার মতো দৃশ্য সেটা এই— দুর্গার মৃত্যুর পর স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে হরিহর কাশী চলে যাচ্ছে। জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা হয়েছে। ছোট্ট অপুও তার জিনিস গোছাতে ব্যস্ত। এক সময় ঘরের পাশে বাঁশের মাচা থেকে কী একটা জিনিস নিতে গিয়ে অপুর হাতের ধাক্কায় নারকেলের একটা মালা মাটিতে পড়ে গেল। আর তার মধ্যে থাকা একটা জিনিসও ছড়িয়ে পড়ল মেঝের উপর। অপু অবাক হয়ে দেখে, সেই পুঁতির মালা, যার জন্য দিদিকে চোর অপবাদ দেওয়া হয়েছে। তবে কি এখন দিদি সত্যিই ‘চোর’ হয়ে যাবে! মালাটি হাতে তুলে অপু এ দিক-ও দিক দেখে। বেরিয়ে যায় বাড়ির পিছন দিকে পুকুরের ধারে। কেউ কোত্থাও নেই। সারা পুকুর ছোট ছোট পানায় ভরা। এক ফাঁকে অপু হাতের মুঠো থেকে মালাটি ছুড়ে দেয় পুকুরের মাঝে। পানার মাঝে গিয়ে পড়ল মালা। পানা সরে কিছুটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল। মালাটা ডুবে গেল আর পরমুহূর্তেই সরে যাওয়া পানা সেই জায়গায় ফিরে এসে ফাঁকটা ভরাট করে দিল। ঠিক যেন দুর্গার এই কলঙ্কটা পুকুর নিজের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে পানা দিয়ে তা ঢেকে দিল। কেউ কোনও দিনও তার হদিস আর পাবে না।

দুর্গার চলে যাওয়ার পর দৃশ্য দু’টি বড় বেশি মনে পড়ছে।

অমলকুমার মজুমদার, শিবপুর, হাওড়া

নাবালিকার বিয়ে

‘কার শাস্তি’ (১৬-১১) সম্পাদকীয়ের বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক জন নাবালিকার পড়াশোনা শিকেয় তুলে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর প্রধান উদ্যোগী হলেন মেয়েটির বাবা-মা। মূল কারণ পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা। কিন্তু এই বিয়ের পরে মেয়েটির জীবন কেমন হয়ে ওঠে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেই নাবালিকা একটি অনটনের সংসার থেকে অন্য আর একটি অনটনের সংসারে প্রবেশ করল।

তাদের দৈনন্দিন জীবন কাটে প্রথমত রান্নাবান্নার কাজে। এ ছাড়াও থাকে বাধ্যতামূলক ভাবে সংসারের অন্যান্য কাজ করা। অনেক সময় তার সঙ্গে বাড়তি কিছু টাকা রোজগারের অভিপ্রায়ে তাদের অন্যের বাড়ি গিয়ে কাজ করতে বা অন্য কোনও রোজগারের পথ নিতে হয়। এই ক্লান্তিকর জীবনে কেউ কেউ হয়তো স্বামীবিচ্ছিন্নও হয়ে যায় পরিস্থিতির চাপে। ইতিমধ্যেই মেয়েটি হয়তো এক বা দুই সন্তানের মা। অথচ তার পাশে স্বামী নেই। পরিবারের কেউ নেই। এমনকি সরকারও নেই। কারণ, রাজ্য সরকার নির্দেশ দিয়েছে, কোনও সময়ে নাবালিকাকে বিয়ে করে থাকলে পরবর্তী কালেও সেই বিয়ে নথিভুক্ত হবে না। অর্থাৎ, সে তার স্বামীর বিরুদ্ধে খোরপোশের মামলা করতে পারবে না। স্বামী, শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির কোনও অংশ দাবি করতে পারবে না। অর্থাৎ, সে তখন কোথায় থাকবে, কী খাবে— কেউ দায় নেবে না। ইরাক, ইরান, আফগানিস্তানের মতো মৌলবাদী রাষ্ট্রে এমন সব ঘটনার খবর পাওয়া যায়। আশ্চর্য লাগে, এখানেও মেয়েদের বিষয়ে এমন শাস্তির ভাবনা!

প্রবীর চক্রবর্তী, গোচারণ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

অন্য বিষয়গুলি:

Uma Dasgupta Satyajit Ray Pather Panchali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy