Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: অবাক আবেদন

তৃণমূলের এক পুরপ্রধান দোলের আগে-পরে মিলিয়ে তিন দিন আমিষ বর্জনের ‘অনুরোধ’ জানিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছেন। প্রশাসনিক স্তরের মাথায় থেকে এমন বেআইনি এবং অসাংবিধানিক ‘আবেদন’ জানালে বিতর্কে তো পড়তেই হবে।

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৪:৩৪
Share
Save

‘দোলে মাছ-মাংস নয়, নেতার আর্জিতে বিতর্ক’ (১৪-৩) শীর্ষক সংবাদে পড়লাম, তৃণমূলের এক পুরপ্রধান দোলের আগে-পরে মিলিয়ে তিন দিন আমিষ বর্জনের ‘অনুরোধ’ জানিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছেন। প্রশাসনিক স্তরের মাথায় থেকে এমন বেআইনি এবং অসাংবিধানিক ‘আবেদন’ জানালে বিতর্কে তো পড়তেই হবে। এমন ‘আবেদন’ নগরজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রয়াসমাত্র। দোল অতিক্রান্ত। কিন্তু এক গণতান্ত্রিক দেশে আগামী দিনের জন্য এমন বিতর্ক গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই।

সংবাদে জানলাম, নবদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের মহাসচিব কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী বলেছেন, দোলের পরিক্রমা চলাকালীন প্রকাশ্যে মাংস কাটার দৃশ্য যাতে ভক্তমনকে আহত না করে, সে জন্য সম্মিলিত ভাবে বিধায়ক ও পুরপ্রধানের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল। এই ভক্তমনের ধর্মানুভূতি পরিমাপের কোনও যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি। দেশে-বিদেশে, বিশেষ করে এই উপমহাদেশে ধর্মানুভূতির আহত হওয়ার বহিঃপ্রকাশ যে কোন ভয়ঙ্কর মাত্রায় পৌঁছতে পারে, তা বার বার দেখে আমরা শিহরিত হয়েছি। আমাদের মতো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে অন্তত প্রশাসনিক স্তর থেকে এই জাতীয় ধর্মানুভূতিকে প্রশ্রয় দেওয়া একেবারেই অনভিপ্রেত।

নবদ্বীপ শহর এবং সংলগ্ন এলাকায় বাজারের বিভিন্ন মানুষ মাছ, মাংস, ডিম বিক্রি করে যেমন সংসার চালান, তেমনই সাইকেলের পিছনে ডালা ভর্তি করে মাছ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করে বহুজন জীবিকা নির্বাহ করেন। এমন ফতোয়া ভবিষ্যতেও দেওয়া হলে শুধু যে তাঁদের দৈনন্দিন রোজগারের পথ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে তা নয়, কেউ যদি এই নির্দেশ অমান্য করে আমিষ পণ্য বিক্রি করতে সচেষ্ট হন, তখন হয়তো রাজনৈতিক কোনও অসাধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী চড়াও হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে ইন্ধন পেয়ে যাবেন। চাই কি তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হেঁশেল বা ফ্রিজেও নীতিপুলিশি শুরু করতে পারেন। তাই পুরপ্রধানের এই ‘আবেদন’ মোটেই সমাজে সুস্থিতি ও শান্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে না।

এই সময় কিন্তু শহরে মদের দোকানগুলি বন্ধ করার কোনও প্রয়াস করা হয়নি। কারণ, সে ক্ষেত্রে উচ্চ প্রশাসনিক সায় পাওয়া কঠিন হত, যে-হেতু রাজস্বের মোটা টাকা সেখান থেকেই আসে। রাসযাত্রার সময় এই নবদ্বীপে দেখেছি ডিজে মাইক বাজিয়ে, গাছপালা আলোকমালায় সাজিয়ে, বোমা-পটকা ফাটিয়ে বহু মানুষ আকণ্ঠ মদ্যপান করে উন্মত্তের মতো নাচছে। সে ক্ষেত্রে পুরসভার কোনও নিয়ন্ত্রণ দেখিনি।

সর্বোপরি, কোনও প্রশাসনিক উচ্চপদে থেকে এ ধরনের ‘আবেদন’ করা নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার হতে পারে না। এটি দায়িত্বশীল পদে থাকা ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রশাসনিক নীতির প্রতিফলন। আর, এ নিয়ে যে নাস্তিক মঞ্চ ও মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর সরব হয়েছে, তা কোনও ভাবেই ভোট পাওয়ার আশায় বা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়। বরং তারা সমাজের সার্বিক কল্যাণ, নাগরিক অধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার স্বার্থেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরছে।

সাধন বিশ্বাস, কলকাতা-১২২

পক্ষপাতদুষ্ট

নবদ্বীপের পুরপ্রধানের দোল উৎসব উপলক্ষে আমিষ বর্জনের ‘অনুরোধ’ বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। যদিও তিনি দাবি করেছেন যে, এটি নির্দেশ নয়, তবু বিষয়টি প্রশ্নের উদ্রেক করে। এক গণতান্ত্রিক দেশে ব্যক্তিগত খাদ্যাভ্যাসের উপর সরকারি প্রতিষ্ঠানের এমন অনুরোধ আদৌ কাম্য কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। যদি এটি নিছক অনুরোধই হয়, তবে পুরসভার মতো প্রশাসনিক সংস্থা কেন এমন বার্তা প্রচার করবে? নবদ্বীপ ঐতিহ্যগত ভাবে বৈষ্ণব তীর্থস্থান হলেও, সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ও ভিন্ন খাদ্যাভ্যাস রয়েছে। প্রশাসনিক ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যখন নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের ভাবাবেগকে সামনে রেখে এমন আহ্বান জানান, তখন তা পক্ষপাতদুষ্ট মনে হতে পারে।

‘নাস্তিক মঞ্চ’ ও এপিডিআর-এর বিরোধিতার জায়গাটি যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত, কারণ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রনিরপেক্ষ কাঠামোতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচিত সবার স্বাধীনতাকে সম্মান জানানো, বিশেষ কোনও ধর্মীয় অনুশাসনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া নয়। আবার, বিজেপি ও তৃণমূলের এই বিষয়ে প্রায় অভিন্ন অবস্থান তাদের রাজনৈতিক দ্বিচারিতার দিকেও ইঙ্গিত করে। ‘নাস্তিক মঞ্চ’-এর রাজ্য সম্পাদক প্রতাপচন্দ্র দাসের মতে, দোলের সময়ে আমিষ বর্জন ও মাছ-মাংস বিক্রি বন্ধের যে আবেদন নবদ্বীপ পুরসভা করেছে, তা ব্রাহ্মণ্যবাদী, সাম্প্রদায়িক ও অসাংবিধানিক। ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও খাদ্যাভ্যাসের উপর এমন হস্তক্ষেপ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। নবদ্বীপের সাধারণ মানুষ তাঁদের ইচ্ছামতো খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখবেন— এটাই হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক চেতনার মূল ভিত্তি। প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের উচিত ধর্মীয় নিরপেক্ষতা বজায় রেখে, সব সম্প্রদায়ের অধিকারের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল থাকা।

মৌসুমী দেবনাথ, নবদ্বীপ, নদিয়া

উপেক্ষার শামিল

নবদ্বীপের পুরপ্রধানের দোল উপলক্ষে শহরবাসীকে তিন দিন আমিষ বর্জনের অনুরোধ জানানোর প্রসঙ্গে বলি— ভারতীয় সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে বিশ্বাস ও খাদ্যাভ্যাসের স্বাধীনতা দিয়েছে। কেউ আমিষ খাবেন কি না, তা সম্পূর্ণ তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। প্রশাসনের কাজ নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা, কোনও ধর্মীয় বিশ্বাসের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া নয়। নবদ্বীপ ঐতিহাসিক ভাবে বৈষ্ণব তীর্থস্থান হলেও, এটি একমাত্র বৈষ্ণবদের বসতি নয়। সেখানে বহু ধর্ম ও মতাদর্শের মানুষ, নাস্তিক, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্করাও বাস করেন। তাই স্থানীয় প্রশাসনের উচিত সব সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি সমান সংবেদনশীল থাকা। গণতন্ত্রে রাষ্ট্র বা প্রশাসনিক সংস্থার নিরপেক্ষ থাকা জরুরি। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভাবাবেগ রক্ষার নামে যদি প্রশাসন কোনও অনুরোধ জানায়, তবে অন্য সম্প্রদায়ের অধিকারের প্রতি তা উপেক্ষার শামিল হয়। নবদ্বীপ পুরসভার উচিত আগামী দিনে এমন বিতর্কিত ভূমিকা থেকে সরে এসে প্রকৃত প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে মনোযোগ দেওয়া।

রুদ্রপ্রসাদ বালা,চাকদহ, নদিয়া

মৃত্যুলীলা

গাজ়ার রাফা শহরের যে ছবি সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে তা দেখে হঠাৎ মনে হয়, কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে! যে ভাবে ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে, তাকে দানবিক বললেও কম বলা হয়। কিন্তু আশ্চর্য এটাই, যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ-সহ বিশ্বের তাবৎ শক্তিশালী দেশ নীরব দর্শক। সাধারণ মানুষ কি এ ভাবেই মরবে চিরকাল? রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়, সাধারণ মানুষের কেন বাঁচার অধিকার থাকবে না? তারা তো যুদ্ধের সৈনিক নয়, অজস্র শিশুই বা কেন মারা পড়বে? যদি কোনও উদ্যোগ করতে না পারে, তা হলে রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে লাভ কি? ইজ়রায়েলেরও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। বহু নিরপরাধ মানুষ মারা গিয়েছেন বা অপহৃত হয়েছেন। তা হলে উভয় পক্ষের রাজনীতিকদের কেন আলোচনার টেবিলে বসানো যাচ্ছে না।

সাধারণ মানুষকে নিয়ে এই মৃত্যুলীলা বন্ধ হওয়া উচিত। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা নিরসন করা যায়, যুদ্ধের মাধ্যমে নয়— এই কথাগুলো কি এখনকার রাজনীতিকদের জানা নেই? না কি তাঁরা ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে গিয়েছেন। চোখের বদলে চোখ কখনও নীতি হতে পারে না, তা হলে তো গোটা পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবে। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিশালী দেশগুলির অনেক বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়া উচিত। পৃথিবীতে কি ‘সভ্য’ রাষ্ট্রনায়ক এক জনও জীবিত নেই?

সেখ মুবারক হোসেন, বড় তাজপুর, হুগলি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Non veg foods non vegetarian Controversy Religious Politics Nabadwip TMC

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}