Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Cons of Digital Transanction

সম্পাদক সমীপেষু: সেই সব মুদিখানা

বিশ্বায়নের এই যুগে সবার হাতে যে সব সুযোগসুবিধা পৌঁছে দেওয়া যাবে না, পিছনে থেকে যাবেন সমাজের একটা বড় অংশ, তা বলে দেওয়াই যায়।

ক্রেতা হারাচ্ছে মুদিখানা।

ক্রেতা হারাচ্ছে মুদিখানা।

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৪:৩২
Share: Save:

পরন্তপ বসুর ‘পাড়ার মুদিখানা আর কত দিন’ (১৬-১) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ক্রমাগত ডিজিটাল হয়ে ওঠার দৌড়ে অক্ষম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ ও তাঁদের সেবায় নিয়োজিত সব ক’টি প্রতিষ্ঠানের যে সলিলসমাধি ঘটতে চলেছে, তার আভাস দিয়ে গিয়েছিল অতিমারি পরিস্থিতি। ‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ’ প্রবাদবাক্যটি আরও এক বার সত্যি প্রমাণ করে দেশ জুড়ে ফলাও প্রচার করা হয়েছিল ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধা। কত সংখ্যক মানুষ এই ব্যবস্থায় সক্ষম এবং স্বচ্ছন্দ, তার সমীক্ষা না করেই নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল নব প্রযুক্তির এই মহাসাগরে। এই ব্যবস্থা আজ সমগ্র ভারতের লেনদেনের একমাত্র মাধ্যম।

পাড়ার মুদিখানার তপনকাকু কিংবা সাইকেল মিস্ত্রি শঙ্করদার কথা তখন ভাবার অবকাশ কোথায়? ডিজিটাল নামক ‘ললিপপ’ অথবা ‘খুড়োর কল’-এ প্রলুব্ধ জনগণকে থামায়, সাধ্য কার? প্রান্তিক মানুষটাকেও বুঝিয়ে দেওয়া গেছে অনলাইনে বিনা পরিশ্রমেই আপনার পরিষেবা আপনার হাতের মুঠোয়। ও দিকে ছোটখাটো কাপড়ের দোকান অথবা মুদিখানার মালিক একটু একটু করে হারিয়েছেন ক্রেতা। ছোটখাটো স্টেশনারি দোকানদার রাস্তা দিয়ে সারা দিন কত জন মানুষ হেঁটে গেল, তার হিসাব করেছেন ক্রেতাহীন দোকানে বসে। খুচরো ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়েছে বড় বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের বিজ্ঞাপন সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলিতে উপচে পড়েছে ক্রেতার ভিড়।

এর পরও অসংখ্য সাধারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ আছেন, যাঁরা কিছুতেই এই ডিজিটাল লেনদেনের বিষয়টি বুঝতে পারেন না। স্মার্টফোন চালাতে অক্ষম সেই সব সহ-নাগরিকের কথা মাথায় রেখেই দেশের গ্রামগঞ্জের বাজারে আজকের দিনেও বাজার বসে, দোকান খোলে নিয়ম করে। তবে হঠাৎ করেই গ্রাম কিংবা আধা শহরে ঘুরতে গেলে চোখে পড়ে বাজারগুলোর পাশেই সুউচ্চ অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে, যেখানে বহুজাতিক কোম্পানির মল তৈরি হবে। স্বাভাবিক কারণেই অপমৃত্যু ঘটবে পার্শ্ববর্তী বাজারগুলোর।

বিশ্বায়নের এই যুগে সবার হাতে যে সব সুযোগসুবিধা পৌঁছে দেওয়া যাবে না, পিছনে থেকে যাবেন সমাজের একটা বড় অংশ, তা বলে দেওয়াই যায়। তাঁদের কথা ভাবতে বসলে কি দেশকে এগোনো যাবে? তাঁদের জন্য রয়েছে সরকারের তরফ থেকে বিনামূল্যে রেশন বণ্টনের নিশ্চিত আশ্বাস। শ্রেণিবিভক্ত এই সমাজের এটাই ভবিতব্য। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারেন যাঁরা, তাঁরাই অর্থনীতির ধারক-বাহক। প্রান্তিক মানুষ সেখানে সংখ্যামাত্র। বেশি দিন টিকে থাকতে পারবেন না জেনেই তাঁরা অভ্যাসবশে দোকান খুলে যাবেন।

রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি

অন্ধকারে ঢাকা

‘পাড়ার মুদিখানা আর কত দিন’ শীর্ষক প্রবন্ধে বাস্তবকে তুলে ধরা হয়েছে।‌ বক্তব্যে সহমত‌ পোষণ করে লিখছি, যে ভাবে বিভিন্ন এলাকায় শপিং মল গড়ে উঠছে, তাতে পাড়ার মুদিখানার ভবিষ্যৎ ক্রমশই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। মধ্যবিত্তের একাংশ এবং উচ্চবিত্তের পুরো অংশ এখন প্রায় সব কিছুই কিনতে ছুটে যান শপিং মলে। নিম্নবিত্ত, দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের কিছু অংশকে নিয়ে চলে ছোট দোকানের ব্যবসা। বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে একই পাড়ায় একাধিক মুদিখানা গড়ে উঠছে। ফলে ক্রমহ্রাসমান খদ্দের ভাগ হয়ে আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে ব্যবসা। সীমিত আয়ে সংসার চালানো দায় হয়ে উঠছে অনেক মুদিখানা মালিকের।

একটা সময়ে পয়লা বৈশাখে হালখাতা করে খদ্দেরদের মিষ্টির প্যাকেট ও ক্যালেন্ডার তুলে দিতে দেখা যেত যে সব মুদি দোকানে, বিক্রিবাটা কমে যাওয়ায় তারা বাধ্য হয়েছে হালখাতার পাট তুলে দিতে। স্বল্প শিক্ষিত, দরিদ্র পরিবারের যে সব বেকার পাড়ায় মুদিখানা খুলে আয়ের কথা ভাবতেন, তাঁদের সেই স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়েছে শপিং মল। একই ছাদের তলায় মুদি দোকানের সামগ্রী, প্রসাধনী, আনাজ, মাছ, মাংস পেতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা শপিং মলকেই বেছে নিয়েছেন। তাই গরিব মানুষের রুজিরোজগার ঠিক রাখতে ঢালাও শপিং মলের লাইসেন্স দেওয়ার উপর লাগাম টানা জরুরি হয়ে পড়েছে। মুদিখানা যাঁরা চালান, বিকল্প ভাবে আয়ের পথ তাঁদের নেই। নিম্নবিত্ত, দরিদ্র মুদিখানার মালিকের স্বার্থের কথা ভাবতে সরকার-সহ কোনও রাজনৈতিক দলকেই এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি

দুই ভাগ

পাড়ার মুদিখানায় যেন পাড়ার লোকদের সঙ্গে একটা আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে। গ্রামের মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা আমাদের দেশে এখনও সেই ভাবে বাড়েনি। তাঁদের চাহিদাও সেই কারণে তুলনামূলক ভাবে সম্পন্ন লোকেদের থেকে কম। তাই সেখানকার ছোট ছোট, কম পুঁজির মুদিখানাগুলিই তাঁদের ভরসা। তারাই সেই মানুষদের ছোট ছোট চাহিদা পূরণে সক্ষম। কম পরিমাণ, কম দামি, প্যাকেটবিহীন, চাকচিক্যবিহীন জিনিসপত্রের জোগান ও চাহিদার আধিক্য সেই সকল মুদিখানাতেই থাকে। সেই সকল মুদি দোকানের ব্যবসা বসতবাড়ির একটা অংশ নিয়েও অনেকে করেন। তাতে বাড়িতে বসেই গৃহকর্তার আয়ের সংস্থান হয়। গৃহকর্তার অনুপস্থিতিতে ক্ষেত্রবিশেষে সেই দোকান বাড়ির অন্য কেউও চালিয়ে নিতে পারেন। আবার সেই দোকানে সাহায্যকারী হিসাবে অন্য এক বা দু’জনের কর্মসংস্থান হয়ে যাওয়ারও সুযোগ থাকে। প্রয়োজনে দোকানের মালিক ধার, বাকিও দিয়ে থাকেন। আবার মাসকাবারির জিনিসপত্রের দাম পরের মাসের বেতন পাওয়ার পরে পরিশোধ করার সুযোগও কোনও কোনও মুদিখানাতে দেওয়া হয়। কোনও একটা জিনিস ক্রয় করার পরে তা খারাপ মনে হলে পরিবর্তনের সুযোগও থাকে। এ সব কিছুই বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয়। এক সঙ্গে অনেক জিনিসপত্র কেনাকাটা করলে ক্রেতার বাড়িতে বিনামূল্যে সে সব পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ থাকে। কোনও একটা জিনিস বাজারে সাময়িক ভাবে অমিল হলে কোনও কোনও দোকানি ক্রেতাকে আশ্বাস দেন, সেই জিনিসটা বাজারে আসামাত্রই তাঁকে দেওয়ার। এটা ক্রেতা-বিক্রেতার পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে তৈরি হয়। প্রধানত এই সকল মুদিখানায় নগদ টাকার বিনিময়ে জিনিস বিক্রি হয়। তবে কোনও কোনও সম্পন্ন ব্যবসায়ী ব্যবসা প্রসারিত করার লক্ষ্যে ডিজিটাল লেনদেন চালু করেছেন।

অন্য ভাবে বলতে গেলে, গ্রামাঞ্চলে এখনও সেই ভাবে অতিবৃহৎ সংস্থার সুপারমার্কেট গড়ে ওঠেনি। কিছু ছোট শহরতলিতে তা গড়ে উঠলেও লোকে অভ্যাসবশত এবং সম্পর্ক গড়ে ওঠার খাতিরে পাড়ার মুদিখানাতেই কেনাকাটা করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। কেনার পরে সেখানে পরিশোধের ব্যবস্থাটাও আধুনিক ভাবে গড়ে উঠেছে। সচ্ছল মানুষ আজ নগদ টাকা খুব কমই সঙ্গে রাখেন। তাই তাঁরা ডিজিটাল পেমেন্টের সাহায্য নেন।

কিন্তু অধিকাংশ বড় সংস্থার বিপণিতে সাধারণত প্যাকেটজাত জিনিস পাওয়া যায়, আবার খুব কম পরিমাণের জিনিসও পাওয়া যায় না। প্যাকেটজাত জিনিসের মূল্য তুলনামূলক ভাবে বেশি। তাই আর্থিক দিক থেকে দুর্বল মানুষের কাছে এই সকল স্টোর নাগালের বাইরে থেকে যায়। কোভিডের সময় দেখেছি কিছু দিনের জন্য অনলাইন স্টোরের ডেলিভারি বন্ধ ছিল বা খুব সতর্কতার সঙ্গে তা করা হত এবং অফলাইন স্টোরগুলিতে লম্বা লাইন পড়ত। তুলনামূলক ভাবে পাড়ার মুদি দোকানগুলি কাছাকাছি থাকার কারণে খুব সহজেই সেই সকল দোকান থেকে জিনিসপত্র কেনাকাটার সুযোগ ছিল।

আমাদের সমাজ আর্থিক দিক দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে দু’টি ভাগ হয়ে গেছে। তাই আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোই পাড়ার মুদিখানাকে বাঁচিয়ে রাখবেন।

সন্তোষ কুমার দেহাওড়া

অন্য বিষয়গুলি:

Digital India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy