প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বিষয়ে ‘শ্রী মনমোহন সিংহ (১৯৩২-২০২৪)’ (২৭-১২) প্রয়াণলেখে উঠে এসেছে, তিনি একাধারে ছিলেন বহুগুণের অধিকারী পণ্ডিতপ্রবর রাষ্ট্রনেতা। তাঁর তিরোধানে ভারত তথা বিশ্ব হারাল বৃহত্তর অর্থে এক জন সমাজ ও অর্থনৈতিক সংস্কারককে। এই পণ্ডিত দেশ-বিদেশের শিক্ষায়তন থেকে ধ্রুপদী অর্থনীতির পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। তেমনই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক থাকার জন্য ফলিত অর্থনীতির স্বরূপ এবং প্রভাব যে সমাজকে উন্নয়নের পথসন্ধান দিতে পারে এই বিষয়ে তাঁর অব্যর্থ ধারণা তাঁকে ভিন্ন এক স্থান দিয়েছে এবং তিনি নিয়ম ভাঙার পদক্ষেপ করতে পেরেছেন।
প্রখর কূটনৈতিক বোধ তাঁকে যে দূরদর্শিতা দিয়েছিল তার ফলে তিনি বুঝেছিলেন উন্নয়নের ভবিষ্যৎ নিহিত উদারীকরণের ভিত্তিতে। আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা যে বর্তমান পৃথিবীতে পরিত্যাজ্য এক সঙ্কীর্ণতা তাও স্পষ্ট বুঝেছিলেন। উন্নয়নের সামাজিক বাস্তবায়নে মনমোহনের কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ আমাদের দেশকে সুফল দিয়েছে। লাইসেন্স রাজের সমাপ্তির দীর্ঘমেয়াদি ফল আজ ভোগ করছেন দেশবাসী। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করে তোলা মনমোহনের আরও এক কৃতিত্ব। তাঁর আমলেই ২০১৩ সালে দেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সুরক্ষা আইনের বাস্তবায়ন ঘটে।
সবাইকে এগিয়ে চলার পথের বন্ধু করে নিতে হবে— এই ছিল তাঁর শিক্ষা। তাঁর নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার দু’বার ক্ষমতায় এসেছে। দু’বারই তিনি কংগ্রেস দলের সংসদীয় নেতা। সঙ্গে ছিল সনিয়া গান্ধীর আশ্বাস। দলের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা সত্ত্বেও জোটবদ্ধ এক সরকারকে দশ বছর এগিয়ে নিয়ে গিয়ে দেশকে যে স্থিতি ও গতি দিয়েছিলেন, তার জন্য তিনি ইতিহাসে বিশেষ স্থানের দাবিদার।
শান্তি প্রামাণিক, উলুবেড়িয়া, হাওড়া
একাই ভদ্রলোক?
প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ স্মরণে কৌশিক বসু ‘এক বিরল ভদ্রলোক’ (২৯-১২) প্রবন্ধে প্রথমেই লিখেছেন, “তিনি এক বিরল গোত্রের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন— প্রজ্ঞাবান, সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী, আনখশির সৎ।” ভারতে রাজনীতি-অর্থনীতি ক্ষেত্রে স্বাধীনতা-উত্তর কালে এক বিভাজন রেখা ১৯৯১-৯৩’এর গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কর্মসূচি। কংগ্রেসের আমলে নয়া উদার রাজ-অর্থনীতির সংস্কার কর্মসূচির কেন্দ্রীয় শক্তি ছিল মনমোহন সিংহের অর্থনীতি ও নরসিংহ রাওয়ের রাজনীতির যুগলবন্দি। মিতভাষী মনমোহন সিংহ আজও সম্মানিত। অপেক্ষাকৃত কম মিতভাষী হলেও নরসিংহ রাও চলে গেলেন বিস্মৃতির অতলে।
তবে রাজনীতির জগতের জন্য সে ছিল শিক্ষণীয় সময়। ১৯৯১-এর পূর্বে রাজনীতি ও অর্থনীতিকে ঘরকুনো বলা হত। তবে তা আজকের মতো বেপরোয়া, অসৎ ও দুর্বিনীত ছিল না। এর কারণ মূলত মধ্যপন্থী জাতীয় কংগ্রেস-সহ বামপন্থী শক্তিগুলির নৈতিক চরিত্র ও গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা। মনমোহন সিংহ এই সময়েরই এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব অবশ্যই।
মনমোহন সিংহের পঠনপাঠন পঞ্জাব, কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ডের উচ্চস্তরের প্রতিষ্ঠানে। কর্মজীবনে উল্লেখযোগ্য দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে ১৯৮২-৮৫ ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের দায়িত্ব পালন, ১৯৮৫-৮৭ ভারতের যোজনা কমিশনের সহ-অধ্যক্ষ ছিলেন, পরে জেনিভায় সাউথ কমিশনের সচিব হন। এ সব লেখক উল্লেখ করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও আমলা। এই সময়ের এক ব্যাঙ্ককর্মী হিসাবে আমার এই মনমোহন সিংহকেই পছন্দ। এই ভূমিকায় তাঁর প্রজ্ঞা, অনুভব, সততা, চরিত্র গঠন ও এ সবের প্রকাশের দিক দিয়ে তিনি বিরল ব্যক্তিত্ব। তবে ‘ভদ্রলোক’ হিসাবে এই সব বৈশিষ্ট্য সেই সময়ের মানুষদের সামগ্রিক পরিচিতির সঙ্গেই মেলে। সেই হিসাবে এমন কিছু বিরল নয়। প্রসঙ্গত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীও রাজনীতির আয়নায় সংযত, প্রজ্ঞাবান ছিলেন। বামপন্থী সাংসদরাও প্রশংসনীয় ছিলেন। এঁদের রাজনৈতিক বক্তব্যে সবার সঙ্গে একমত নই কিন্তু এঁদের ‘স্টেটসম্যান’ বা রাষ্ট্রনায়ক ভাবতে ভাল লাগে।
মনমোহন সিংহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে সরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চলে গেলেন। ১৯৯১-পূর্ব তাঁর পূর্বাশ্রমের সঙ্গে যা মেলে না। ১৯৯১-৯৬ তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন, ২০০৪-২০১৪ সময়কালে দু’বার তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এ যেন গাওস্করকে অলিম্পিক্সের সুইমিং প্রতিযোগিতায় নামানো। ব্যাঙ্ককর্মী হয়ে মেনে নিতে পারিনি। কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে জোর করে বেসরকারিকরণ ও ব্যাঙ্কিং শিল্পে সুনামির মতো নানা অপরিণামদর্শী অবিবেচনাপ্রসূত যান্ত্রিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে যখন, তখন তিনি অর্থমন্ত্রী হয়ে এই সব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ও তাড়াহুড়ো করে তা কার্যকর করতে বাধ্য হয়েছেন। আমার ধারণা মনমোহন সিংহের অর্থনৈতিক শিক্ষা ও দীক্ষা এই কাজের সঙ্গে সহমত ছিল না।
তার আগে আশির দশকে গ্যাট চুক্তি, ডাঙ্কেল প্রস্তাব ইত্যাদির ক্ষেত্রে আমলা হিসাবে মনমোহনের ভূমিকায় রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও তা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু অর্থমন্ত্রী ও পরে যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব ট্রেজ়ারি— এই ত্রিমূর্তিকেন্দ্রিক ওয়াশিংটন কনসেনসাস-এর চাপে অর্থনীতিবিদ গবেষক মনমোহন সিংহ হেরে গেলেন অসহায় রাজনীতিবিদ মনমোহন সিংহের কাছে। সে দিক থেকে এই ‘বিরল ভদ্রলোক’-এর পরাজয় ভারতের ব্যাঙ্কিং শিল্পে মারাত্মক ক্ষতি করেছে যার ফল আজও ভুগতে হচ্ছে। যান্ত্রিকীকরণ ও উদারীকরণ দরকার ছিল, কিন্তু এত আগ্রাসী ভাবে নয়। উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি না করে ব্যাঙ্কিং শিল্পে একশো শতাংশ কম্পিউটারাইজ়েশন-এর কুফল দেখা যাচ্ছে। ডিজিটালি অপ্রশিক্ষিত বিশাল গ্রাহক পরিবারের অনেকে আজও এই ব্যবস্থার অনুপযুক্ত, যাঁরা সাইবার জালিয়াতির ভুক্তভোগী।
আইন ও শাসনব্যবস্থা প্রথম থেকেই দুর্নীতির দ্বারা অল্পবিস্তর প্রভাবিত। কিন্তু এখন দুর্নীতি যেন সমাজে মান্যতা পেয়ে গিয়েছে। অভিযুক্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতারা বেমালুম ভোট পেয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছেন। বাকি জনগণকে হুঙ্কার দিয়ে নীতি শেখাচ্ছেন। আইনকানুন সাহসী হয়ে কাগজে-কলমের বাইরে যেতে ইতস্তত বোধ করছে। লেখক উল্লেখ করেছেন, “দুর্নীতি ও সাঙাততন্ত্র বিষয়ে তিনি গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন।” এই প্রসঙ্গে জানতে খুব ইচ্ছা হয়, মনমোহন সিংহ এই সময়ের বিষয়ে গ্রন্থ লিখলে কী লিখতেন?
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
তাঁর জয়
‘এক বিরল ভদ্রলোক’ প্রবন্ধ মনমোহন সিংহকে নতুন ভাবে চেনাল। এই মৃদুভাষী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আস্থাভোট-বিতর্কের সূচনালগ্নে দশম শিখগুরু গোবিন্দ সিংহের বাণী উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, “দে শিবা বর মোহে, শুভ কর্মণ তে কভু না ডর্রু। না ডরু আরসো জব যায়ে লডু, নিশ্চয় কর আপনি জিত করু।” (হে ঈশ্বর, আমাকে সেই শক্তি দিন যাতে শুভ কাজে ভয় না পাই। যুদ্ধে যেন ভীত না হই। জীবন দিয়েও যেন জয় নিশ্চিত করতে পারি।) সেই সময় বাম-বিজেপি শিবির তাঁকে জেরবার করে তুলেছিল। টানা দু’দিন সংসদে আস্থা প্রস্তাব নিয়ে জোর তর্কযুদ্ধের অবসানে জিতেছিলেন তিনি, জয়ী হয়েছিল তাঁর দলও। তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, পরমাণু চুক্তির প্রশ্নে ক্রমাগত বামেদের আক্রমণে স্বভাবতই তাঁর অন্তঃকরণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তিনি আর রক্ত ঝরতে দিতে নারাজ। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, ‘দরিদ্র’, ‘অজ্ঞ’ ভারতকে বিশ্বদরবারে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে প্রতিপন্ন করার জন্য সে সময় পরমাণু চুক্তি রূপায়ণ জরুরি ছিল। আস্থাভোটে জয়ী হয়ে তিনি আর্থিক সংস্কার রূপায়ণেরও সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy