Advertisement
০৮ জানুয়ারি ২০২৫
Gauri Prasanna Mazumder

সম্পাদক সমীপেষু: শুধু দূর থেকে দূরে

এখন আর পুজোর গানের বই বোধ হয় প্রকাশিত হয় না। একটা সময় হিজ় মাস্টার্স ভয়েস থেকে পুজোর গানের বই প্রকাশ হত। গানের শিল্পীর সঙ্গে থাকত গান গীতিকার ও সুরকারের নাম।

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:৩৩
Share: Save:

দেবজ্যোতি মিশ্রের প্রবন্ধ ‘তাঁর গানের স্বরলিপি’ (৭-১২) অতীত দিনের স্মৃতি উস্কে দিল। সেই প্রসঙ্গে কিছু কথা। বাংলা ছায়াছবি ও আধুনিক গানের জগৎকে যাঁরা স্বর্ণযুগে পরিণত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। গীতরচনায় তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল শব্দচয়ন। আজ দুই বাংলায় নানা অস্থির পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর লেখা একটি গান বিশেষ করে মনে পড়ছে— ‘মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে...’।

এখন আর পুজোর গানের বই বোধ হয় প্রকাশিত হয় না। একটা সময় হিজ় মাস্টার্স ভয়েস থেকে পুজোর গানের বই প্রকাশ হত। গানের শিল্পীর সঙ্গে থাকত গান গীতিকার ও সুরকারের নাম। সেখানে প্রচুর গানের গীতিকার থাকতেন গৌরীপ্রসন্নবাবু আর তাঁর সঙ্গে সুরকার নচিকেতা ঘোষের নাম পড়তাম। এই যুগলবন্দি ছিল এক স্বর্গীয় বন্ধন যা বাংলা গানকে সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। কত কত অবিস্মরণীয় গান আর কত গানের ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই গানগুলির সঙ্গে। আরও কত গান! সে যুগের সুরকারদের স্পর্শে সেগুলিতে প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছিল। নচিকেতা ঘোষ ছাড়াও ছিলেন শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অনিল বাগচী, অনুপম ঘটক আর সুরের জাদুকর সলিল চৌধুরী। ছিলেন তরুণ সুপর্ণকান্তি ঘোষও। সব প্রজন্মের সুরকারের সুরে সাবলীল ছিলেন গৌরীপ্রসন্নবাবু। সেই সময়ের প্রায় সকল পরিচালকের প্রিয় ছিলেন তিনি। কারণ গল্পের সঙ্গে সাযুজ্যময় কথা বসিয়ে গান রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর প্রায় সমস্ত গান এখনও মানুষের মনের মণিকোঠায় চির অমলিন হয়ে বিরাজমান। প্রবন্ধকার ঠিকই প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলা আধুনিক গানে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন যে মানুষটি, তাঁকে তাঁর প্রাপ্য যথাযথ সম্মান আমরা কি দিতে পেরেছি? চিনতে পেরেছি কি তাঁর প্রতিভাকে? তাই হয়তো তিনি নিজেই লিখেছেন ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না...’

তমাল মুখোপাধ্যায়, ডানকুনি, হুগলি

সেই ইন্দ্রধনু

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের স্মরণে দেবজ্যোতি মিশ্রের লেখা প্রবন্ধটির সঙ্গে আরও কিছু কথা সংযোগ করতে ইচ্ছা হল। ১৯২৪ সালের ৫ ডিসেম্বর পাবনা জেলায় তাঁর জন্ম। কাকতালীয় ভাবে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের জন্মও পাবনা জেলায়। এক জন স্বনামধন্য গীতিকার অন্য জন সিনেমাজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় ছায়াছবির জন্য তাঁর গীত রচনা শুরু। তার পর ধীরে ধীরে পরিচয় শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, অনিল বাগচী, নচিকেতা ঘোষ, অনুপম ঘটক, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, আরতি মুখোপাধ্যায় এবং অন্যান্য গুণিজনের সঙ্গে। পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত আধুনিক বাংলা গানের ‘স্বর্ণযুগ’-এর অন্যতম কারিগর। এ সময়ে যে হিট ছায়াছবিগুলিতে তিনি গীতিকার হিসাবে কাজ করেছেন তার কয়েকটি— অগ্নিপরীক্ষা, হারানো সুর, পথে হল দেরী, দীপ জ্বেলে যাই, সাগরিকা, ছায়া সঙ্গিনী, শুধু একটি বছর, সূর্যতপা, চিরদিনের, সূর্যসাক্ষী, প্রক্সি, নন্দন, নীল আকাশের নীচে, অতল জলের আহ্বান ও আরও অসংখ্য ছায়াছবিতে তিনি ছিলেন গীতিকার। এ ছাড়া তিনি বহু কাহিনি ও গল্প লিখেছিলেন। তার কয়েকটি নিয়ে সিনেমাও হয়েছিল।

ছায়াছবিতে প্রাসঙ্গিকতা, প্রয়োজনীয়তা এবং চিত্রনাট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি যে গানগুলি লিখে গিয়েছেন, তার কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করলাম— ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’, ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার’, ‘এ শুধু গানের দিন’, ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’, ‘জীবনখাতার প্রতি পাতায়’, ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’, ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম’, ‘না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’। আজও এই গানগুলিই উৎসব-পার্বণে, বিনোদনে বাংলার আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়ায়। আর বাঙালি প্রাণভরে উপভোগ করে। এই প্রসঙ্গে এও বলা দরকার যে, সুরকার এবং কণ্ঠশিল্পীদের অবদানও অনস্বীকার্য। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গানগুলিকে এত প্রাণবন্ত করে তোলার পিছনে তাঁদের প্রতিভার ভূমিকাও রয়েছে।

তাই বাংলার সঙ্গীতশিল্পী, চলচ্চিত্র জগৎ, সাহিত্যিক, শ্রোতা, নাট্যকর্মী সকলের কাছে অনুরোধ করি, কবি-গীতিকার ও লেখক গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং সেই সঙ্গে গীতিকার-সুরকার সলিল চৌধুরীর শতবর্ষ সরকারি ও বেসরকারি ভাবে সমারোহ সহকারে উদ্‌যাপনের দাবি তুলুন। এতে তাঁদের দু’জনের প্রতি কিছুটা শ্রদ্ধা জানানো যাবে।

স্বপন আদিত্য কুমার বিশ্বাস, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

এমন বন্ধু...

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার প্রসঙ্গে দেবজ্যোতি মিশ্রের লেখা ‘তাঁর গানের স্বরলিপি’ প্রবন্ধটি সুখপাঠ্য। আত্মবিস্মৃত হিসাবে বাঙালির একাংশের দুর্নাম আছে, তারা খুব সহজেই সব কিছু ভুলে যায়, যা তাদের দীর্ঘ দিন মনে রাখার কথা। শুধু তা-ই নয়, প্রশংসা-কৃপণও বটে।

১৯৮৬ সালে গৌরীপ্রসন্নের অকালে চলে যাওয়ার আগে তো নয়ই, তার পরেও তাঁর মূল্য বুঝতে গানপ্রেমীরা ব্যর্থ। সব দশকেই দেখেছি, বাংলা গানের গীতিকারেরা গায়ক বা সুরকারের চেয়ে আলোর ভাগ কম পেতেই অভ্যস্ত থাকেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তারই উদাহরণ। অথচ, তাঁর গানের বাণিজ্যিক সাফল্য ঈর্ষা করার মতো। কিছু গান মনে করিয়ে দিই।

১৯৮৩ সালে যে গানের শেষ তিনটি লাইন লেখা হয়েছিল সিগারেট প্যাকেটের গায়ে, এক সময় বিবিসি সেরা বাংলা গানের তালিকায় যে গানটাকে নির্বাচিত করেছিল, মান্না দের কণ্ঠে সেই ‘কফিহাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গান বা বাংলা সিনেমার শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক গীতির অন্যতম, সপ্তপদী ছবির হেমন্ত-সন্ধ্যার কণ্ঠে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’-কে শ্রোতারা চিরজীবন মনে রাখবেন। কিন্তু অধিকাংশই ভুলে গিয়েছেন গানগুলির গীতিকার গৌরীপ্রসন্নকে।

কালজয়ী সঙ্গীতের তালিকায় থাকবে ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’, ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’, ‘কে তুমি আমারে ডাকো’, ‘কিছুক্ষণ আরো না হয়’, ‘এই মেঘলা দিনে একলা’, ‘তীর ভাঙ্গা ঢেউ আর নীড় ভাঙ্গা ঝড়’, ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’, ‘দোলে দোদুল দোলে’, ‘আশা ছিল ভালবাসা ছিল’, ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে’ গানগুলো।

সোনার কলম হাতে নিয়ে জন্মানো মানুষটাকে আজ আর একটু বেশি স্মরণ করলে তাঁকে বিস্মরণের প্রায়শ্চিত্ত সম্ভব হবে?

অরূপরতন আইচ, কোন্নগর, হুগলি

দু’টি পথ

দেবজ্যোতি মিশ্রের কলম-অর্পিত গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের শতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘তাঁর গানের স্বরলিপি’ পড়ে কিছু সংযোজন করতে চাই। উত্তম কুমার প্রযোজিত এবং উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন অভিনীত হারানো সুর ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গীতা দত্ত গেয়েছিলেন, ‘তুমি যে আমার’। গানটির গীতিকার ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, গানটিতে লিপ দিয়েছিলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন।

অনেকেই হয়তো জানেন না, ওই ছবিতেই রেডিয়ো থেকে ভেসে আসা একটি গানের দৃশ্যায়নে হেমন্তবাবুর কণ্ঠে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগের কথা ভাবা হয়েছিল। সেই গানটি ছিল, ‘আমার এ পথ তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে’। কিন্তু এ নিয়ে নাকি আপত্তি ওঠে বিশ্বভারতী মিউজ়িক বোর্ডের তরফে। কারণ দু’টি গানই রবীন্দ্রসঙ্গীত না হলে সে সময় গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা ছিল। এতে ছবির প্রযোজকেরও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা। তখন ডাক পড়ল গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের। তিনি রবীন্দ্রনাথের ওই গানটিতে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখলেন একটি কালজয়ী গান, ‘আজ দু’জনার দু’টি পথ ওগো দু’টি দিকে গেছে বেঁকে, তোমার ও পথ আলোয় ভরানো জানি আমার এ পথ আঁধারে আছে যে ঢেকে’।

সেই গান আজও বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে রেখেছে। আর সপ্তপদী ছবিতে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে এবং হেমন্ত-সন্ধ্যা কণ্ঠে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ বাংলা চলচ্চিত্রের গানের আকাশে আজও ধ্রুবতারা হয়ে বিরাজ করছে। কবি-গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে জানাই শতবর্ষের প্রণাম।

শুক্লা সেনগুপ্ত, কলকাতা-৭৪

অন্য বিষয়গুলি:

Gauri Prasanna Mazumder Bengali Cinema Bengali Music lyricist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy