Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Mother

সম্পাদক সমীপেষু: আমের আঁটি

আজও সম্পন্ন ঘরে বহু মা বা স্ত্রী আছেন, যাঁরা আম কেটে সাজিয়ে দেন স্বামী-সন্তানদের, পরে তাদের না খাওয়া আমের আঁটিটি থেকেই আমের স্বাদ নেন।

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২২ ০৪:৫৩
Share: Save:

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়, অন্বেষা সেনগুপ্তর ‘খাওয়া না-খাওয়ার পালা’ (২৯-৪) শীর্ষক রচনাটি বড় নাড়া দিল। মায়ের কথা মনে পড়ল, প্রতিফলিত হল আজকের মা এবং স্ত্রী’দের কথা। সত্যি অবাক লাগে ভাবতে, মা কী করে এত কম বা সামান্য খেয়ে দিন কাটাতে পারতেন! শুধুই কি অভাবের কারণে, না কি সেই অন্নপূর্ণার ভান্ডার তিনি বিলিয়ে দিয়েই পুষ্টি পেতেন? এত কৃচ্ছ্রসাধন যেন ছিল তাঁদের সাধনা, তাঁদের তৃপ্তির কারণ।

আজও সম্পন্ন ঘরে বহু মা বা স্ত্রী আছেন, যাঁরা আম কেটে সাজিয়ে দেন স্বামী-সন্তানদের, পরে তাদের না খাওয়া আমের আঁটিটি থেকেই আমের স্বাদ নেন। ‘ওরা আঁটি খেতে পারে না...’ এই তাঁদের পরিতৃপ্ত করে, যেমনটি আগে হয়েছে। আজও বিরল নয় ভাল দেখে মাছের টুকরো যত্নে-আদরে স্বামীর পাতে তুলে দেওয়া। ‘ও ওই টুকরো ছাড়া খেতে পারে না!’ বলা বাহুল্য, কম কাঁটাওয়ালা ইলিশ মাছের টুকরোতে খালি স্বামীদেবতারই অধিকার। কষ্ট করে কাঁটা বেছে ইলিশ মাছের স্বাদ নেওয়ার সময় তাঁর নেই— এই তথ্য গ্রহণযোগ্যতা পায় শুধুমাত্র গৃহবধূদের কাছেই নয়, কর্পোরেটের মই বেয়ে বেশ উঁচুতে ওঠা গিন্নিও এই ভাবেই পরিবেশন করে মাছ বা আমের স্বাদ নেন। তবে এই ধারায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন এসেছে, আসছে, আসবে, এবং আসা উচিতও।

চৈতালী তরফদার
সিঙ্গাপুর

সমান নয়
পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রীতিনীতি, বিধিনিষেধ, দায়িত্ব-কর্তব্য, শোভন-অশোভনের ধারণা মিলিয়ে মিশিয়ে একটা অদ্ভুত ঘেরাটোপ তৈরি হয়। সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায় ও অন্বেষা সেনগুপ্তের প্রবন্ধটি প্রসঙ্গে অতীতেও দেখেছি, আজও দেখছি, সংসারের যাবতীয় শিষ্টাচার মেনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় হাল ধরতে হয় সেই বাড়ির গৃহিণীকেই। কী করে চলতে হবে, কেমন করে চালাতে হবে ছেলে, মেয়ে, স্বামী সকলের মন জুগিয়ে নিজের কথা না ভেবে, তিনি ছাড়া ওই রোজগেরে কর্তাটির পক্ষে কি এ সব সম্ভব? তিনি না পারবেন সংসারের হাল ধরতে, না পারবেন এই দুর্মূল্যের বাজারে, কাটছাঁট করে সব দিক বজায় রেখে সংসারের কান্ডারি হতে।

প্রতি দিন সংসারে রমণীদের অনেকেই নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থ ভাবে পরিবারের সুখ-শান্তি কামনায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন কর্মে। এমনকি নজর দেন না নিজের আহার্যে। কিন্তু তাঁকে দেখার অভাব থেকেই যায়। কথায় আছে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। কিন্তু রমণীদের প্রতি পুরুষেরও তো কিছু দায়বদ্ধতা আছে বা থাকা বিধেয়। অধিকার, মর্যাদা রক্ষায় আজকের সমাজে নারী-পুরুষ সমান সমান। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। নারীকেই পাশ করতে হয় কঠিন সব যোগ্যতার পরীক্ষায়। সেই পরীক্ষার মধ্যে তাঁর বাহ্যিক সৌন্দর্য থেকে শুরু করে পরিবার গঠনের পরের আত্মত্যাগ— সব কিছুই যুক্ত। দাম্পত্য জীবনকে সুখে রাখতে আত্মসুখ ভুলে পুরুষদেরও পরিবারের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত। দিনের শেষে পুরুষ ও নারী উভয়ের কাজ যখন শেষ হয়, দেখা যায় পুরুষটি বাড়িতে বিশ্রাম নেন, আর নারীকে রন্ধন-সহ বাড়ির নানা কাজে লাগতে হয়। এটা নিঃসন্দেহে অনৈতিক, অমানবিকও।

উৎপল মুখোপাধ্যায়
চন্দননগর, হুগলি

একার দায়িত্ব?
‘খাওয়া না-খাওয়ার পালা’ প্রবন্ধটি একেবারে বাস্তবের সঙ্গে মিলে গেল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের ‘সেকেন্ড জেন্ডার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্রসঙ্গেএকটা বহুল প্রচলিত গল্প মনে পড়ল। এক ছিঁচকে চোর জমিদারের কাছারি বাড়িতে একটা বড় কাতলা মাছ এনে বলল, এই মাছ শুধু জমিদারগিন্নি আর বাড়ির মেয়েরা খাবেন, কারণ সে পিছনের দরজা দিয়ে চুরি করতে এসে দেখেছে, সবার খাওয়ার শেষে গিন্নিমারা তেঁতুলপাতার ঝোল দিয়ে ভাত খান। জমিদারের চোখ কপালে উঠল। তিনি তদন্ত করে দেখলেন ঘটনা সত্যি। অর্থাৎ, ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে যুগ যুগ ধরে এমন ব্যবস্থাই চলে আসছে। মেয়েরা যে মাতৃজাতি, সংসারের সমস্ত কর্মকাণ্ডের ভার তাঁদের উপর ন্যস্ত, তাঁদের যে কোনও ভাবেই কম খাওয়া দিয়ে বা পুষ্টিকর খাবারের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগতে দেওয়া যাবে না, এই সহজ সত্যটাই আজও প্রতিষ্ঠিত হল না।

কয়েক দশক আগে আমার ছোটবেলায় বাড়ির অনুষ্ঠানে খেতে বসে মা মাছের মুড়োটা দাদার পাতে না দিয়ে আমার পাতে দিলে প্রতিবেশিনীরা মাকে সরাসরি আক্রমণ করেন যে, মাছের মাথাটা খোকার পাতে না দিয়ে তিনি কেন খুকুর পাতে দিলেন। আমার যুক্তিবাদী মা তখন হেসে বলেছিলেন, “আমার ছেলের কাঁটা, মাথা এ সব খেতে অসুবিধে হয়, কিন্তু আমার মেয়ে পছন্দ করে খায়, তাই দিলাম।” মেয়েদের নিজেদেরকে পুরুষের মতোই এক জন মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে। লেখকদ্বয় সাহিত্যের অনেক উদাহরণ দিয়েছেন। সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ মানা হয়। বনফুলের লেখা অগ্নীশ্বর-এর একটা অংশ মনে লাগে। ডাক্তার অগ্নীশ্বর রোগিণীর পথ্যের ব্যবস্থা করে দিলে তিনি তা নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাইয়ে দেন। রোগ না সারায়, ডাক্তারবাবু খোঁজ নিয়ে বিষয়টা জেনে সকলের জন্যই দুধের ব্যবস্থা করলেন। অফিসে চাকরি করতে গিয়ে অনেক মহিলা সহকর্মী বা ট্রেনে, মেট্রোয় অনেক চাকরিরতা মহিলাদের দেখেছি গলব্লাডারে স্টোন হতে। সকাল থেকে দুপুরে টিফিন টাইম পর্যন্ত দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকার ফলে এমনটা হয়েছে, ডাক্তারবাবুরা জোর দিয়ে এই কথাটা বলেন। আসলে সংসারে স্বামী, সন্তানের খাবারের ব্যবস্থা করে, ঠিক সময়ে অফিস যাওয়ার জন্য, সংসার অফিস দুটোকেই ঠিকমতো সামাল দিতে না পারার অপরাধবোধে তাঁরা নিজের খাওয়াটাই বাদ দিয়ে দেন! সংসারের দায়িত্বটি যে তাঁর একার নয়, এই কথাটা নিজে না বুঝলে অন্যকে বলবেন কী করে?

শিখা সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫১

অন্নপূর্ণা
আমাদের ভারতীয় মেয়েদের ছোট থেকেই এমন শিক্ষা দেওয়া হয় যে, মেয়েদের খিদে পাওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলা যেন একটা লজ্জার ব্যাপার। এমন একটা ধারণা হয়ে গেছে যে, পরিবারের সবাইকে খাইয়ে তবেই মেয়েরা খাবে, এটাই প্রকৃত ভাল মেয়ের কর্তব্য! ‘মেয়েমানুষের নোলা’ থাকতে নেই! মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত সব বাড়িতেই কিন্তু আগে উৎকৃষ্ট খাবার (মাছের মাথা, দুধটা, ফলটা) বাবা, ভাই, স্বামী, শ্বশুর, ছেলে খাবে, তার পর বাঁচলে বাড়ির মেয়েরা। কারণ পুরুষমানুষকে বাইরে গিয়ে মাথা ঘামিয়ে রোজগার করে নিয়ে আসতে হয়, আর মেয়েরা তো শুধুমাত্র ঘর সামলান! অবশ্য এখন মেয়েরাও চাকরি করে, কিন্তু প্রথাটা রয়েই গেছে।

এ তো গেল সমস্যার কথা, কিন্তু এর সমাধান মেয়েরাই করেছে। গ্রামীণ প্রান্তিক পরিবারের মেয়েরা পুকুর, ডোবা থেকে চুনোমাছ, গুগলি ধরে প্রোটিনের জোগান দেন নিজেকে, পরিবারকে। শহরে না হলেও গ্রামে কিন্তু সব বাড়িতেই নিজেদের ছোট বাগানে মেয়েরা পুঁই, কুমড়ো, লাউ, ঝিঙে, নানাবিধ শাক বুনে, পেয়ারা, আম, জাম, কলা, কাঁঠাল গাছ পুঁতে টাটকা ফলের জোগান দিয়ে থাকেন। মুশকিল হল শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের। তাঁরা সত্যিই পর্যাপ্ত খাবার পান না। এবং তাঁরা সামাজিক যে অবস্থানে বাস করেন, তাতে প্রান্তিক পরিবারের মেয়েদের মতো নিজেদের খাবার জোগাড় করতে পারেন না। শেষে এ কথা বলতেই হবে, নারীর অন্নপূর্ণা কল্যাণী মূর্তি বজায় থাকুক, সবার মুখে তাঁরা অন্ন ধরুন, কিন্তু তার সঙ্গে নিজে অভুক্ত না থেকে, নিজের খাওয়ার জন্যও পর্যাপ্ত খাবার জোগাড় করে রাখুন।

সর্বানী গুপ্ত
বড়জোড়া, বাঁকুড়া

অন্য বিষয়গুলি:

Mother family Mango
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy