জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘এক কালখণ্ডের যাত্রা’ (১৬-৩) প্রবন্ধটি প্রসঙ্গে কিছু বক্তব্য। ছয় দশক পর সত্যজিৎ রায়ের নায়ক ছবিটি নতুন প্রিন্টে দেখে নতুন করে কিছু ভাবনা ভেসে এল। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় খুঁটিনাটিগুলি বরাবরই প্রাণ পেয়ে জেগে ওঠে, বুদ্ধিমান দর্শককে সচকিত করে। কণ্ঠস্বরভিত্তিক অতি-অভিনয় বদলে যেতে শুরু করে পথের পাঁচালী ছবির পর। আর, অরিন্দমের মতোই উত্তমকুমারের অভিনয় তাঁর আগের আমলের তারকাদের অভিনয়ের তুলনায় অনেক নিচু গলার সংযত কথন।
মনে পড়বে ছবির একটি অমোঘ স্বপ্নদৃশ্য। সাদা দরজা, সাদা খড়ির লাইন, অন্ধকার, কালো চশমা পরা মানুষ। চলচ্চিত্রের পর্দায় এক সময় এক্সপ্রেশনিজ়ম ফুটে উঠেছিল প্রতিদ্বন্দ্বী-র স্বপ্নদৃশ্যগুলিতে। এ ক্ষেত্রে দু’টি স্বপ্নই যে অবচেতন থেকে উঠে আসছে তা অদিতির (শর্মিলা ঠাকুর) সঙ্গে প্রথম স্বপ্নের পর অরিন্দমের (উত্তমকুমার) কথোপকথনে স্পষ্ট। দ্বিতীয় স্বপ্নদৃশ্যটি অরিন্দমের এক অব্যক্ত পাপবোধের প্রকাশ, যা ছবিকে দেয় আড়ালে থেকে যাওয়া একা হয়ে থাকার যন্ত্রণায় ভরা বেঁচে থাকার সুর। প্রথম স্বপ্নদৃশ্যে টাকার চোরাবালিতে ডুবে যেতে যেতে পরিত্রাণের জন্য শঙ্করদার নাম ধরে আর্তনাদ করেন নায়ক। বৃত্তের ভিতরে বৃত্ত, বাইরে যাওয়ার পথ কোথায়? এ ক্ষেত্রে টাকার ভূমিকা ষাটের দশকের সমকালীন ভারতীয় সমাজ-অর্থনীতির প্রবণতাগুলিকে তুলে ধরে। রওনা হওয়ার সময় অরিন্দম যে একগুচ্ছ টাকার বান্ডিল সঙ্গে নেন, তা ‘কালো টাকা’ হওয়াও অসম্ভব নয়। স্বপ্নদৃশ্যের ‘কালো টাকা’র (লক্ষণীয়, অসংখ্য কঙ্কালের হাত) স্তূপ কি অবচেতন আত্মবিলুপ্তির আতঙ্কের অভিব্যক্তি? এ শুধু স্টারডমের সাম্রাজ্য খোয়ানোর ভয় নয়, অর্থলোভী সমাজে ভদ্র ভাবে বেঁচে থাকতে না-পারার অসহায়তাও বটে। টাকার নোটের বৃষ্টির মধ্যে স্লো-মোশনে অরিন্দমের হাঁটা দেখে মনে হয়, কাজ নয়, টাকাই এখন তাঁর আরাধ্য হয়ে উঠেছে।
প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি
অন্য দ্বৈরথ
জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘এক কালখণ্ডের যাত্রা’ প্রবন্ধটি পড়ে জানা গেল, কয়েক দশক আগে আমার মতো যে দর্শকরা প্রথম নায়ক ছবিটি দেখেছিলেন তাঁরা সপরিবারে আবার ছবিটি দেখতে আসছেন হল-এ। জেনে যতটা ভাল লাগল, ঠিক ততটাই হতাশা জাগল, যখন জানলাম, যাঁরা প্রথম দেখতে আসছেন তাঁদের সংখ্যা হাতেগোনা। তবে কিছু খবরে প্রকাশ, তরুণ-তরুণীরা ছবিটি দেখতে আসছেন। ছবিটি কেন সর্বকালের ক্লাসিক হিসাবে বিবেচিত হয় তা বিচার করার জন্য এটি তাঁদের কাছে দুর্দান্ত সুযোগ। ছবিটি নির্মাণের ছয় দশক পরও কেন এত প্রাসঙ্গিক? এত সম্পদ অর্জনের পর কেন এক ব্যক্তি এত একা এবং বিষণ্ণ বোধ করেন?
সত্যজিৎ রায় একাধিক বার বলেছেন, “আমার মনে হয় উত্তম ছবিটির জন্য একেবারে একাত্ম হয়ে কাজ করেছেন।” শুনেছি, প্রিয় শিষ্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এই চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সত্যজিৎ রায় সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন! যেমন ছবি বিশ্বাস বা সন্তোষ দত্ত চলে যাওয়ার পর তিনি বিশ্বম্ভর রায় বা জটায়ু তো বটেই, তার সমগোত্রীয় কোনও চরিত্রও অন্য কারও জন্য ভাবেননি।
আসলে নায়ক শুধু এক অভিনেতার যাত্রার কাহিনি নয়। চলচ্চিত্রটি থিয়েটার ও সিনেমার মধ্যে একটি বিতর্কের মধ্যেও প্রবেশ করেছিল। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল নির্বাক থেকে সবাক যুগে পা রাখা। আমার মতে নায়ক ছবির প্রেক্ষিতে, আরও বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল এই বাংলায় চলচিত্র-থিয়েটারের সাংস্কৃতিক দ্বৈরথ। ১৯৫৩ সালে বাংলার দর্শক তিন দশকের দেব-দেবীর মাহাত্ম্য-সম্পর্কিত সিনেমা থেকে বেরিয়ে সাড়ে ৭৪ দেখে চলচ্চিত্রে বিনোদনের স্বাদ পেলেন। সেই সিনেমার পরিচালকের তারিফের সঙ্গেই সত্যজিৎ উত্তমবাবুর যাত্রা-থিয়েটারের সংলাপ বলার কায়দাবর্জিত অভিনয়েরও ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। তা বলে, অভিনয়ের অন্য ধারার গুরুত্ব সত্যজিৎ রায়ের কাছে কিছু কম ছিল না, তা তিনি ‘অপ্সরা থিয়েটারের মামলা’ রহস্যগল্পে বুঝিয়ে দিয়েছেন। নির্বাক-সবাক বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন ‘জুটি’।
নায়ক ছবিতে, সর্বশেষ ফিল্ম ফ্লপ হওয়ার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা অবস্থায়, অরিন্দমের দুঃস্বপ্নে আছে, তিনি আনন্দিত হয়ে টাকার স্তূপে ছুটতে শুরু করেন। কিন্তু সেগুলো দ্রুত চোরাবালিতে পরিণত হয়। যখন অরিন্দম সেই চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছেন, সেই সময় উপস্থিত তাঁর নাট্য-পরামর্শদাতা শঙ্করদা তাঁকে বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। পরে, শঙ্করদা অপর ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার-জগতের তারকা হিসাবে উপস্থিত হন, যিনি দুর্গাপূজার জন্য নাটক তৈরি করেন। তিনি বলেন, চলচ্চিত্রের অভিনেতারা যত বড় শিল্পীই হন, আদতে তাঁরা পরিচালকমণ্ডলীর হাতের পুতুল। ক্ষমতা অনুযায়ী আত্মপর্যালোচনায় কোথায় এবং কখন থামতে হবে তা বর্তমান প্রজন্মের জন্য দারুণ শিক্ষা।
শর্মিলা ঠাকুর তখন খ্যাতির শিখরে, অরিন্দমের ছদ্মবেশী বিবেকের ভূমিকায় অনবদ্য। তাঁদের মধ্যে গভীর বন্ধন তৈরি হয়। দিল্লিতে পৌঁছে, শর্মিলা নোটগুলি ছিঁড়ে ফেলেন। কারণ এটি প্রকাশিত হলে নায়কের স্টারডম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দুর্বল মুহূর্তে বলে ফেলা গোপন কথা অভিমানে বা ক্রোধে, বহু অনুরোধেও কাউকে বলে না দেওয়াটাই বন্ধুত্বের সেরা মর্যাদা। এও এক শিক্ষা।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৭
রাজনীতিও দায়ী
ভারতের পরিবার, কর্মক্ষেত্র, মেয়েদের যোগ্য কি না— প্রশ্ন তোলা হয়েছে ‘মেয়েদের ইচ্ছা’ (১১-৩) সম্পাদকীয়তে, সেই জিজ্ঞাসা আজ দেশের প্রতিটি সংবেদনশীল নাগরিকেরই। কর্মক্ষেত্রে মর্যাদা ও বেতনের ক্ষেত্রে যে বৈষম্যের শিকার হন অধিকাংশ নারী, তা নিয়ে কোনও সরকারেরই তেমন হেলদোল আছে কি? অথচ দেখা যায়, নারীদিবসে নারীদের বিভিন্ন অসুবিধা ও তার প্রতিকার নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় সরকার বা বিরোধী দলের নেতৃত্বের মুখে সমবেদনা, প্রতিশ্রুতির ছড়াছড়ি। ভোটযুদ্ধে জয়লাভের জন্য প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নারীদের জন্য অনুদানকে প্রায় নিলামে চড়িয়ে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। কিন্তু এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলি মেয়েদের প্রতি চরম অবমাননাকর বলেই মনে করা হয়। আরও দুর্ভাগ্যজনক যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত কাজকর্ম দেখাশোনা করেন পুরুষেরাই, তাই মেয়েদের নামে বণ্টন করা টাকা অনেক ক্ষেত্রেই চলে যায় পুরুষদের দখলে এবং খরচও হয় তাঁদেরই ইচ্ছামতো।
পুরসভা বা পঞ্চায়েতে নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধিদের হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করেন সেই প্রতিনিধির ‘পুরুষ অভিভাবক’। প্রতিটি দলেই প্রায় সিংহভাগ নেতৃত্বের দখলদারি হাতছাড়া করতে নারাজ এই পুরুষেরাই। শ্রমবাহিনীতে মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির বিষয়ে, বিশ্ব ব্যাঙ্কের শীর্ষ আধিকারিকের যে বক্তব্য আলোচিত হয়েছে, তা সাম্যতান্ত্রিক সমাজ গঠনে হয়তো সাহায্য করবে, কিন্তু অনেকাংশেই খর্ব হবে পুরুষের অধিকার, যা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য, প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই মেয়েদের কর্মনিযুক্তির দাবিতে নারীকেই একযোগে এগিয়ে আসতে হবে, নারীদের মর্যাদা দানে বাধ্য করতে হবে সরকার ও সমাজকে।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)