—ফাইল চিত্র।
প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘দেশহীনতার আতঙ্ক’ (১৪-৩) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ২০১৪ সালের পর থেকেই গোটা দেশের নাগরিকদের কোনও না কোনও বিষয়ে উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগের মধ্যে রাখাটা কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত কর্মসূচি হয়ে উঠেছে। নোটবন্দি থেকে শুরু হয়েছে। এখন সিএএ, আগামী দিনে এনআরসি— এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়াই কেন্দ্রের উদ্দেশ্য। আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে সিএএ হল ধর্মীয় কারণে উদ্বাস্তু মানুষদের (মুসলিমদের বাদ দিয়ে) নাগরিকত্ব প্রদান করার আইন। প্রবন্ধে যথাযথ ভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে, কোনও ধর্মীয় কারণে উদ্বাস্তু মানুষ নিয়মমাফিক নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করার পরে কাগজপত্র যাচাই করে যদি তা বাতিল হয়, তা হলে কি তিনি বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হয়ে যাবেন? এর কোনও সঠিক উত্তর নেই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলছেন, এই আইনের প্রয়োগে কোনও ব্যক্তির নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে না।
এটা ঠিক যে, বেআইনি অনুপ্রবেশ আমাদের রাজ্যের তথা দেশের একটা বড় সমস্যা। এই বেআইনি অনুপ্রবেশ বন্ধ করা এবং অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিত। বেআইনি অনুপ্রবেশ শুধুমাত্র আমাদের দেশের নয়, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশরও বড় সমস্যা। কিন্তু আমাদের দেশে অসমে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিতকরণের নামে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এক কলমের খোঁচায় ‘সন্দেহভাজন’ নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। কার্গিল যুদ্ধের শহিদ পরিবারও এই তালিকা থেকে বাদ যায়নি। সেই কারণেই দেশহীনতার আতঙ্ক থেকে নাগরিকদের মুক্ত করতে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত সিএএ এবং এনআরসি সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের পরিকল্পনা কোনও রকম লুকোছাপা না করে নাগরিকদের সামনে তুলে ধরা।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
ভোটের মিঠাই
‘দেশহীনতার আতঙ্ক’ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। নির্মলকুমারী মহলানবিশের স্মৃতিকথা থেকে আমরা জানতে পারি, অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ মৃত্যুশয্যায় মানবসভ্যতার বিষয়ে অনেকক্ষণ বলে গিয়েছিলেন। তাঁর মূল বক্তব্য ছিল, সমস্ত পৃথিবীর মানবসমাজকে সমগ্র ভাবে এক করে দেখতে পারলে আর কোনও ভাবনা থাকে না। নিজেদের টুকরো টুকরো করে দেখা থেকেই দুঃখের সৃষ্টি। বৌদ্ধ সম্প্রদায় নিজেদের কেটে মহাযান ও হীনযানের সৃষ্টি করল, খ্রিস্টের উপাসকরা তাঁর উপদেশ ভুলে নিজেদের নানা টুকরো করেছে। হিন্দুধর্ম, ইসলাম ধর্ম, সর্বত্রই এক ইতিহাস। রামমোহনের বাণীও সেই সমগ্র মানব সমাজকে এক করে দেখার বাণী, কিন্তু আমরা কি তা গ্রহণ করেছি? “ধর্ম দিয়ে তো আমরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছি, তাই এত মারামারি হানাহানি আজকে...” (‘রবীন্দ্রকল্পনায় বিশ্বমানব’, দেশ, ২৭-৫-২০০০)
বর্তমান ভারত টুকরো টুকরো করে সমাজকে ভেঙে দেওয়ার খেলাতেই মত্ত। লোকসভা নির্বাচনের মুখে নাগরিকত্ব আইনকে বলবৎ করার যোগ্য সময়টি খুঁজে পেল শাসক দল। যদিও সমগ্র দেশের জন্যই এই আইনটি বলবৎ করা হয়েছে, তবুও শাসকের মূল লক্ষ্য দেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, ভোটের ফলাফলকে নিজেদের অনুকূলে আনার বাসনা। এই আইন মোতাবেক পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, খ্রিস্টান প্রমুখ নাগরিকত্বের আবেদন জানাতে পারেন।
প্রশ্ন থেকে যায়, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি কি বিগত পাঁচ বছরের উন্নয়নমূলক কাজের উপরে আর আস্থা রাখতে পারছে না! না কি, কেন্দ্রের জনবিরোধী কার্যকলাপগুলিকে এই বিভাজনের ভারতে ‘সিএএ’-র ঢাকনায় চাপা দিতে চায়? অর্থাৎ, ক্ষুধা-অপুষ্টি, বেকারত্ব, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মূলধন আত্মসাৎ করে এক শ্রেণির শিল্পপতির পালিয়ে যাওয়া, সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, কৃষক আন্দোলন, পরিযায়ী শ্রমিকের দুর্দশা, মণিপুরে নারী-নির্যাতন, বিলকিস বানো ধর্ষণ কাণ্ডে অভিযুক্তদের মুক্তি, সিদ্দিক কাপ্পানদের বাক্স্বাধীনতা হরণ, দেশদ্রোহিতার নামে ফাদার স্ট্যান স্বামীর কারাগারে মৃত্যু, খাদ্য-শিক্ষা-পরিধান-রুচি সব কিছুতেই ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব, সর্বোপরি দেশজোড়া ধর্মের এবং জাতপাতের নামে বিভাজন— ঢাকা পড়ে যায় নাগরিকত্ব আইন নামক ধোঁয়াশায়।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
বিভেদ-নীতি
আগামী লোকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত আগে, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি, তৃণমূল-সহ অন্যান্য দলের তহবিলে কোটি কোটি টাকা (সিপিএম ব্যতীত) জমা পড়ার নথিপত্র যখন সুপ্রিম কোর্টের কল্যাণে মানুষের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে গত ১১ মার্চ রাতে কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৯ সালের পাশ করা নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী (সিএএ) কার্যকর করল। জয়দীপ বিশ্বাসের “ভয়ের ‘বিধি’লিপি” (১৯-৩) প্রবন্ধের একটি লাইন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ— সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভাবে অচ্ছুতকরণ মানব সভ্যতার পুরনো বদভ্যাস। ২০১৯ সালে প্রণীত ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের ষষ্ঠ সংশোধনী একগুচ্ছ প্রশ্ন, বিতর্ক, সন্দেহ, সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। এই সংশোধনী ভারতীয় সংবিধান প্রদত্ত সাম্যের অধিকারকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। মুসলমান এবং অ-মুসলমানদের মধ্যে বিভাজনরেখা টানার একটা জোরালো প্রয়াস আইনটির অন্যতম অঙ্গ। অনেক প্রশ্ন এক জায়গায় জড়ো হয়েছে— কেন শুধুমাত্র তিনটি পড়শি দেশ (বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান) থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে নির্দিষ্ট ছ’টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের বিশেষ ছাড়ের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে, তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা মেলেনি। যদি নিপীড়িত, নির্যাতিত, ছিন্নমূল ভিন দেশি মানুষদের ভারতে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়াটাই এই সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্য হত, তা হলে জাতিগত, রাজনৈতিক বা অন্যান্য নিপীড়নের কারণে উচ্ছিন্ন মানুষদের জন্য এই সংশোধনী আইনে শিথিলতার কোনও সংস্থান রাখা হল না কেন? এই অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে মুসলমান, ইহুদি-সহ অন্য ধর্মাবলম্বীরা কেন বাদ পড়লেন? চিন, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, কিংবা নেপাল থেকে আগত সংখ্যালঘু হিন্দু, তিব্বতি বৌদ্ধ, তামিল শরণার্থী বা উইঘুর মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা কেনই বা ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রশ্নে বিশেষ ছাড় পাবেন না? কী হবে তসলিমা নাসরিনের মতো প্রতিবাদী লেখিকার? ভারত কি তার দরজা বন্ধ করে দেবে? পাকিস্তানের শিয়া, বালুচ, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ কেনই বা প্রযোজ্য হবে না?
অসমের ১৯ লক্ষ মানুষের এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়ার ঘটনা অনিশ্চয়তার বাতাবরণ তৈরি করবেই! যে সমস্যাগুলোর সহজে সমাধান করা সম্ভব, প্রয়োজনমতো সেগুলো বড় করে নেন রাজনীতির নেতারা। মানুষে-মানুষে বিভেদের রাজনীতি নতুন কিছু নয়। ১৯৩৫ সালে একই ভাবে জার্মানিতে জারি হয়েছিল ন্যুরেমবার্গ আইন, যার ভিত্তিতে নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন নাৎসি পার্টি জার্মান এবং ইহুদিদের মধ্যে বিভাজনের উপর লাগিয়েছিল রাষ্ট্রীয় সিলমোহর! আজ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার কৌশলী বাস্তবায়ন রাষ্ট্রীয় উৎসাহে শুরু হয়েছে। তৎসত্ত্বেও এ কথা সত্য যে, বহুত্ববাদী ভারতীয় নাগরিক সমাজের অন্তস্তলে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা এখনও বহমান। মৌলিক অধিকারের ঘোর অমাবস্যাকালে শুধুমাত্র একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ‘বিপদ’ বলে মনে করা হলে আদতে ভারতের মৌলিক কাঠামোই অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে।
সৌমিত্র মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy