বর্তমানে সারা দেশেই আশি-নব্বইয়ের দশকের তুলনায় পাট চাষ ও উৎপাদন ক্রমহ্রাসমাণ। ফাইল ছবি।
‘কাঁচা পাটের ঘাটতি রুখতে পরিকল্পনা’ (৪-৪) শীর্ষক খবরের পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্র। ভারতীয় পাট নিগমের (জেসিআই) ৫২তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সংস্থার এমডি জানিয়েছেন, কাঁচা পাটের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পাট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সকল পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বর্তমানে সারা দেশেই আশি-নব্বইয়ের দশকের তুলনায় পাট চাষ ও উৎপাদন ক্রমহ্রাসমাণ। এর কারণ, চাষের খরচ বৃদ্ধি, সুলভে শ্রমিকের অভাব, চাষিদের লাভজনক মূল্য না পাওয়া, এবং সর্বোপরি আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণ। কাঁচা পাটের ব্যবসায় সত্তরের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত জেসিআই-এর যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, বিগত দুই দশক ধরে তা অন্তর্হিত হয়েছে। সংস্থার কর্মচারী সংখ্যা, ক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা লক্ষণীয় মাত্রায় কমেছে। জেসিআই গঠিত হয়েছিল পাট চাষিদের কাছ থেকে সহায়ক মূল্যে পাট কিনে চাহিদা অনুযায়ী চটকলগুলিকে সরবরাহ করা, এবং পাটের বাজারকে স্থিতিশীল রাখার উদ্দেশ্যে। বর্তমানে জেসিআই-এর সার্বিক পরিকাঠামোকে এমন স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে যে, গত দুই দশকে জেসিআই দেশের সমগ্র উৎপাদনের মধ্যে গড়ে ২-৩ শতাংশ পাটও চাষিদের থেকে ক্রয় করতে সমর্থ হয়নি। অতএব তার আজ সেই ক্ষমতা নেই যে, সে পাটের জোগান ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে এক নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা নিতে পারে।
পাটের মূল্য স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রেও জেসিআই-এর ভূমিকা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। কাঁচা পাটের মূল্য বৃদ্ধি ও মজুতদারি তখনই অতিমাত্রায় ঘটে, যখন দেশে উৎপাদন কম হয়। বর্তমানে পাট চাষে নতুন নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে, উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহার করা হচ্ছে, জাতীয় পাট পর্ষদ আছে, কৃষকদের প্রশিক্ষণের জন্য কোটি কোটি টাকা প্রতি বছর ব্যয় করা হচ্ছে, তবুও পাট চাষের এলাকা বাড়ছে না, উৎপাদন ক্রমশ কমছে। সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখা যায়, রাজ্যের কোনও না কোনও চটকল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কাঁচা পাটের অভাবে, কিংবা শ্রমিক অশান্তির ফলে। একদা রাজ্যের অন্যতম কর্মসংস্থানকারী শিল্প আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। পরিবেশ সহায়ক তন্তু পাটের তৈরি সামগ্রীর চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ছে, অথচ পাট শিল্পের অবস্থা সমস্যাসঙ্কুল। শুধু ঠান্ডা ঘরে বসে রচিত পরিকল্পনা পাটশিল্পের সমস্যা সমাধানে অতীতেও কাজ দেয়নি, এ বারও কোনও কাজে আসবে না।
দেবকী রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়, প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, জেসিআই অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন
চাষির ক্ষতি
এ বছরের মতো আলু তোলার পালা শেষ হয়েছে। এ বার দাম না থাকায় চিন্তায় পড়েছেন আলু চাষিরা। হিন্দু-মুসলিম, দুই সম্প্রদায়ের কৃষকরাই তাঁদের প্রধান উৎসবের আগে ফসলের ভাল দাম পেলে নিজেদের পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে পারেন। অনেক আশা নিয়ে দিনরাত শ্রম দিয়ে তাঁরা ফসল উৎপাদন করেন। তবু কি দিনের শেষে লাভের মুখ দেখতে পান চাষিরা? আলু উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে। কিন্তু বছর বছর আলু চাষের খরচ অনেক বাড়ছে। এ বছর বিঘা প্রতি আলু চাষের খরচ হয়েছে পঁচিশ হাজার থেকে তিরিশ হাজার টাকা। আলু তোলার প্রথম দিকে বস্তা প্রতি (৫০ কিলোগ্রাম) আলুর দাম ছিল ৩০০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা। সবচেয়ে ভাল ফলন হলে বিঘা পিছু ৮০ থেকে ১০০ বস্তা আলু পাওয়া যায়। এখন আলুর বস্তা প্রতি যা দাম, তাতে বড়জোর চাষের খরচ উঠে আসবে। তা হলে দিনরাত পরিশ্রম করে লাভ কোথায়? এ ক্ষেত্রে যাঁরা বড় চাষি, তাঁরা বেশি দাম পাওয়ার আশায় হিমঘরে আলু মজুত করে রাখেন। অনেক সময় দাম মেলে, আবার কখনও জলের দামেও সেই আলু বিক্রি করতে হয়। কিন্তু যাঁরা মাঝারি বা ছোট চাষি, তাঁরা মাঠ থেকে সরাসরি ব্যবসাদারদের হাতে এই ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। তাঁরা অনেকে মহাজনের থেকে টাকা ঋণ অথবা গয়না বন্ধক রেখে আলু চাষ করেন। তাঁদের কাছে ওই ফসল বিক্রি করে যেটুকু টাকা পাওয়া যায়, তাই দিয়ে ঋণ পরিশোধ করাটা বেশি জরুরি হয়ে ওঠে।
চাষিরা উৎপাদিত আলুর দাম পান না, অথচ শহরাঞ্চলে পাইকারি বাজারে এই ফসলই অনেক বেশি টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া বাইরে থেকে আলুবীজ আনা বন্ধ করে রাজ্যে আরও বীজ গবেষণা কেন্দ্র করলে এত দাম দিয়ে আর বীজ কিনতে হবে না চাষিদের। কেবলমাত্র সরকারের ‘কৃষকবন্ধু’, ‘কিসান সম্মান নিধি’, ফসল বিমাই নয়, এই সমস্ত দিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে উপযুক্ত পদক্ষেপ করলে তবেই চাষিরা উপকৃত হবেন।
সারা বছর এই ভাবে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ও স্বল্প লাভ এবং বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকেন চাষিরা। তবু তাঁদেরই উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকেন আর এক শ্রেণির মানুষ। প্রতি বছর আলু তোলার মরসুমে এক দল মানুষ এক মাঠ থেকে আর এক মাঠে আলুর খোঁজে হেঁটে চলেন। এঁদের মধ্যে মজুর, শ্রমিক অনেকেই আছেন। তাঁরা কেউই নিজেরা আলু চাষ করেন না। সারা দিন কাজের পর আলু-তোলা জমিতে কোদাল বা পাসুনি দিয়ে মাটি খুঁড়ে আরও আলুর সন্ধান পাওয়া যায়। আট থেকে আশি বছর, সকলে দল বেঁধে আলু কুড়ানোর কাজে মেতে থাকেন। ছোটদের দল এই আলুর কুড়িয়ে বড়দের দিয়ে বিনিময়ে আইসক্রিম বা শনপাপড়ি পেয়ে থাকে। এই আলু কুড়িয়ে অনেকে সারা বছর খাওয়ার মতো আলুও সংগ্রহ করে ফেলেন। আলু-চাষিরাও অনেকে নিজেদের পরিচিতদের ডেকে অল্প কিছু আলু দিয়ে থাকেন। আর বলেন, ঈশ্বর ও আল্লার কাছে প্রার্থনা করতে, যেন চাষিদের সুদিন আসে।
সুকমল দালাল, খণ্ডঘোষ, পূর্ব বর্ধমান
গাছের প্রাণ
সাম্প্রতিক গবেষণায় গাছের জীবনচক্র নিয়ে কিছু চমকপ্রদ তথ্য সামনে এসেছে। যেমন, যন্ত্রণায় সাড়া দেয় গাছ। ব্যথা পেলে তারা আর্তনাদ করে, এমনকি অবহেলা করলে তারা কাঁদেও। সন্তানদের চিনতেও পারে। গাছের এক-এক প্রজাতি এক-এক ধরনের ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চালায়, যদিও তা মানুষের শ্রবণসীমার বাইরেই থেকে যায়। ইজ়রায়েলের তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে গাছের সেই ভাষা শুনেছেন, তা রেকর্ডও করেছেন। এই যুগান্তকারী গবেষণাটি মর্যাদাপূর্ণ বৈজ্ঞানিক জার্নাল সেল-এ এই বছরেই গত ৩০ মার্চ প্রকাশিত হয়েছে।
গাছের বলা ‘শব্দ’ রেকর্ডিং-এর আগে, টমেটো, তামাক, ভুট্টা, গম, আঙুর ও ক্যাকটাস গাছের উপর নানা ধরনের পরীক্ষা চালিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিছু গাছে একটুও জল দেওয়া হয়নি। কিছু গাছের ডাল কাটা হয়েছে। আবার কিছু গাছ যেমন ছিল, তেমন অবস্থাতেই তাদের রাখা হয়েছে। যারা জল পায়নি, অথবা যাদের ডাল কাটা পড়েছে, তারা ওই সময়ে টানা ১০ থেকে ১২ বার আর্তনাদ করে নিজেদের কষ্টের কথা ব্যক্ত করেছে। মানুষ যেমন ব্যথা পেলে ককিয়ে ওঠে, ঠিক তেমন ভাবেই তারাও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
গাছেরও যে অনুভূতি আছে, এই কথা বহু বছর আগে প্রথম আমাদের সামনে এনেছিলেন বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। তিনি লক্ষ করেছিলেন, গাছের জীবন যেন মানুষের জীবনেরই ছায়া। উদ্ভিদের জন্ম, বৃদ্ধি, বংশ-বিস্তার, মৃত্যু, ভয়-ব্যথা-আনন্দ অনুভবের ক্ষমতা তো আছেই, এমনকি অন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রতি সমব্যথী হওয়ার ক্ষমতাও তাদের আছে। আমরা এমন এক দিনের অপেক্ষায় আছি, যে দিন গাছের সঙ্গে মানুষের সরাসরি কথা বলা সম্ভব হবে।
মানুষের চাইতে উদ্ভিদকুল ও প্রাণিকুলের অধিকার কিছু কম নয়। অথচ, মানুষের সীমাহীন অত্যাচারে মানুষ নিজে যেমন বিপন্ন, তেমনই এরাও আজ বিপন্ন, বিলুপ্তপ্রায়। এদের কষ্ট, আর্তনাদ মানুষের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছয় না।
অরুণকুমার ঘোষ, কলকাতা-১২০
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy