আমি এক জন চিকিৎসক, দেশে ও বিদেশে মিলিয়ে কাজ করেছি তিন দশকেরও বেশি। বিগত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ দেশে করোনাভাইরাস ঘটিত পরিস্থিতিতে লোকের অযথা আতঙ্ক নিয়ে এই চিঠি।
আমার এক সহকারী ভয়ানক উদ্বিগ্ন হয়ে আমায় ফোন করে বললেন: আমাদের পাড়ায় তিনটে গলি বাদে এক জনের পজ়িটিভ বেরিয়েছে, কী হবে! অর্থাৎ মারণ-ভাইরাস দুয়ারে এসে পড়ল— নিস্তার নেই। স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতি দিন বাড়িতে পাড়ায় দোকানে বাজারে হেনস্থা হচ্ছেন। কোনও এলাকায় কোভিড- ১৯’এর চিকিৎসাকেন্দ্র বা কোয়রান্টিন সেন্টার খুলতে গেলে স্থানীয় মানুষ তেড়ে আসছেন। এমনকি শ্মশানঘাটে করোনা সন্দেহযুক্ত মৃতদেহ পর্যন্ত সৎকার করতে দেওয়া হচ্ছে না— সর্বপবিত্রকারী (পাবক) অগ্নিদেবকেও মানুষ ভরসা করছে না। সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলিও জ্বর হাঁচি কাশি বা কোনও ‘কোভিড সন্দেহযুক্ত’ লক্ষণের রোগী দেখলেই বেঁকে বসছে (কারণ কোভিড-ছোঁয়া থাকলেই হাসপাতাল দু-চার সপ্তাহের জন্য ‘সিল’ হয়ে যাবে)। সব থেকে হতাশাজনক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম— অমুক অঞ্চলে করোনার হানা— যেন বাঘ-সিংহ আসছে!
অথচ এমন হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। ইংল্যান্ডে আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী ডাক্তার ক’দিন আগে করোনা পজ়িটিভ হয়েছিলেন। হাসপাতাল থেকে তাঁকে ১৪ দিন ঘরে থাকতে বলা হয়েছিল। তার পরে তিনি আবার যথারীতি কাজে যাচ্ছেন। এমনকি ওই ১৪ দিন তাঁর ডাক্তার সহধর্মিণীও একই বাড়িতে থেকেও নিয়মিত হাসপাতালে গিয়েছেন। কারণ সেটাই ও-দেশে স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশ।
একটা কথা পরিষ্কার করে বলা ভাল: আমি একদমই বলছি না যে করোনাভাইরাস সংক্রমণে কোনও বিপদ বা ভয় নেই । কিন্তু আবার করোনাভাইরাস মানেই অবধারিত মৃত্যু, এমনটাও নয়। প্রায় ৮০% করোনা পজ়িটিভ রোগীর শরীরে কোনও রোগ-লক্ষণ থাকে না, বা থাকলেও সামান্য। প্রায় ১৫%-এর শরীরে রোগ-লক্ষণ প্রকাশ পায়— এবং তা সাধারণ সর্দিকাশি বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো। ৫-৭% রোগীর ক্ষেত্রে অসুখের বাড়াবাড়ি হয়, হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর হার ২-৩%। এবং মৃতরা সাধারণত শারীরিক ভাবে অশক্ত (তথ্যসূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট)। অর্থাৎ এক জন সুস্থ সবল লোকের করোনাভাইরাস সংক্রমণ হলেও, বড় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কেউ যদি বলেন, সামান্য হলেও এই ঝুঁকিই বা নেব কেন, নিজের প্রাণ বলে কথা! সে ক্ষেত্রে আমি দুটি কথা বলব।
প্রথমত, এক মাস বা দু’মাস লকডাউন করে ঘরে বসে থাকলেই ভাইরাস দূর হবে না। বরং এটা জেনে রাখা ভাল যে, এই ভাইরাস অন্তত ৬ থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত আমাদের মধ্যে থাকবে, বা আরও বেশি। এবং এই ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাক্কা (সেকেন্ড ওয়েভ) অনেক বেশি জোরালো বা ঘাতক হওয়ার সম্ভাবনা। তা হলে কত দিন ঘরে বসে থাকবেন? এই ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই চলার উপায় ভাবতে হবে। পৃথিবীতে বেশ কিছু দেশ (যেমন তাইওয়ান) বিনা লকডাউনেই করোনাভাইরাসের আক্রমণকে সামাল দিতে পেরেছে।
দ্বিতীয়ত, এই দেশে আমরা সকলে এর চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়েই প্রতি দিন রাস্তাঘাটে চলাফেরা করি। আমাদের দেশে বছরে দৈনিক প্রায় দেড় হাজার মোটর দুর্ঘটনা
ঘটে। তাই বলে কি আমরা রাস্তায় হাঁটি না?
দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা-৭১
মৃত্যুর ধারাভাষ্য
তাপস সিংহ লিখিত ‘একটি মৃত্যুর ধারাবিবরণী’ (৫-৫) সত্যিই নাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের বিবেককে। ১২ বছরের শিশু শ্রমিক জামলো মকদমের মর্মান্তিক মৃত্যুর মতো, এই লকডাউন আরও বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ধারাভাষ্য তৈরি করেছে।
যেমন, লকডাউন ঘোষণার ঠিক পরের দিন সংবাদপত্র ও সামাজিক মাধ্যমে সাড়া ফেলে দেওয়া ঘটনাটি। অন্ধ্র প্রদেশের এক গ্রামের দিনমজুর মাঞ্চালা মনোহর তাঁর পাঁচ বছরের ছেলের গলায় সংক্রমণ হওয়ায় তাকে বাঁচানোর বহু চেষ্টা করেও পারলেন না, দিনমজুরের টাকার জোগাড় কই? পরের দিন মারা গেল ছেলে। এ বার তাকে নিয়ে যেতে হবে শ্মশানে। কিন্তু লকডাউনে কী ভাবে যাবেন? ছেলের লাশকে কাঁধে তুলে হাঁটতে লাগলেন। ৮৮ কিলোমিটার হেঁটে চিত্রাবতী নদীর তীরে এসে দাহ করলেন সন্তানকে। তার পর হতভাগ্য পিতা কত ক্ষণ কেঁদেছিলেন, সেটা সংবাদপত্র লেখেনি। অন্ধমুনির সন্তানকে হত্যা করায় রাজা দশরথকে অভিশাপ দিয়েছিলেন মুনি। সন্তানহারা দিনমজুর কাকে অভিশাপ দিলেন? দারিদ্রকে, অসুখকে, না কি ১০১ জন বিলিয়নেয়ার সমৃদ্ধ এই ভারতবর্ষকে? খবরটি পড়ে মনে পড়ছিল শ্রীজাতর কবিতার লাইন দুটি: “সব হারানোর পরও আশীর্বাদী পিতা/ উঠেছে অর্ধেক চাঁদ। লজ্জিত বাকিটা।’’
এর কিছু দিন পরেই আরও এক শিশুমৃত্যুর ধারাবিবরণী শোনাল সংবাদমাধ্যম। বিহারের গ্রামের প্রান্তিক চাষি গিরিজেশ কুমারের তিন বছরের ছেলে বেশ কয়েক দিন ধরে অসুস্থ ছিল। প্রথমে তাকে স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানকার ডাক্তাররা কোনও পরীক্ষা না করেই তাকে একটি সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। কোনও মতে একটা অটো জোগাড় করে সেখানে নিয়ে গেলে, চিকিৎসকরা বলেন এখুনি তাকে অক্সিজেন দিয়ে পটনা হাসপাতাল নিয়ে যেতে। প্রায় দু’ঘণ্টা চেষ্টা করেও কোনও অ্যাম্বুলান্স পাওয়া যায়নি, এ দিকে চলছে লকডাউন। অগত্যা ছেলেটির মা তাকে কোলে নিয়ে দৌড় লাগালেন পটনার রাস্তা ধরে, পিছনে ছুটলেন গিরিজেশ ও তাঁদের কন্যা। আধ ঘণ্টা ছোটার পর দম নিতে দাঁড়ালেন মা, তখনই লক্ষ করলেন, ছেলে আর নেই। লকডাউন থাকায় সেই মায়ের কান্না ক’জন শুনতে পেয়েছিলেন, জানা নেই। যেমন কবি শ্রীজাত লিখেছেন, “সভ্যতার অভিধানে খামতি শুধু এই/ মায়ের কান্নার কোনও প্রতিশব্দ নেই।’’
মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে পরিকল্পনাহীন ‘সম্পূর্ণ লকডাউন’ এ ভাবেই বার বার মৃত্যুর পরোয়ানা লিখে চলেছে। দিল্লির আর এক পরিযায়ী শ্রমিক ৩২৫ কিলোমিটার অতিক্রম করে মধ্যপ্রদেশে তাঁর গ্রামে যাওয়ার পথে মারা গেছেন। এ রাজ্যের দুর্গাপুরে একটি ইস্পাত কারখানায় টানা পাঁচ দিন অনাহারে থাকার পর মারা যান ঠিকা শ্রমিক সঞ্জয় সিংহ।
পরিসংখ্যান বলছে, করোনার কারণে যত মানুষের মৃত্যু হওয়ার কথা ছিল, তার থেকে ৪৯ শতাংশ বেশি মানুষ বিশ্ব জুড়ে মারা গেছেন। বেশির ভাগ করোনা-বহির্ভূত মৃত্যু হচ্ছে পরিকল্পনাহীন লকডাউনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়। ভারতের মতো চূড়ান্ত আর্থ-সামাজিক অসাম্যের দেশে এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল বেকারি আর অনাহার।
নিবন্ধের শেষে তাপস সিংহ লিখেছেন “জামলোর করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। গোটা জীবনে এটাই জামলো মকদমের একমাত্র পজ়িটিভ।’’ ওই কিশোরীকে করোনা নয়, হত্যা করেছে এই ভারতীয় ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্র, যেখানে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত উড়োজাহাজের নরম আসনগুলি প্রবাসী উচ্চবিত্ত ভারতীয়দের জন্যই বরাদ্দ থাকে। আর জামলোদের জন্য পড়ে থাকে ঘরে ফেরার শত শত মাইল পথ এবং মৃত্যু।
অজেয় পাঠক
হরিণডাঙা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
তখন দূরত্ব
সংবাদপত্রে হোক বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, সব্জি বাজার হোক বা ব্যাঙ্কে টাকা তোলার লাইন, সর্বত্রই সাধারণ মানুষকে সাংবাদিক ও পুলিশের কাছে শুনতে হচ্ছে: সোশ্যাল ডিসট্যান্স বজায় রাখুন। অথচ সাধারণ মানুষ টিভিতে দেখছেন, মুখ্যমন্ত্রী রাস্তা দিয়ে হেঁটে বিভিন্ন বাজার ও হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে, তাঁর ছবি তোলার জন্য ও বাইট নেওয়ার জন্য সাংবাদিকরা রীতিমতো একে অপরকে ঠেলেঠুলে সামনে আসার চেষ্টা করছেন। তখন কোথায় সামাজিক দূরত্ব?
প্রণয় ঘোষ
কালনা, পূর্ব বর্ধমান
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy