Advertisement
০৫ ডিসেম্বর ২০২৪
Education System

সম্পাদক সমীপেষু: শিক্ষায় অন্ধকার

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা অব্যবস্থার বহুমুখী এই সংবাদচিত্র ওই দিনেই চারের পাতায় প্রকাশিত সুকান্ত চৌধুরীর ‘কর্মনাশা হিসাবহীন’ প্রবন্ধে আরও স্পষ্ট ও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে।

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:৪০
Share: Save:

গত ১২ নভেম্বর এই সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছিল ‘চক-ডাস্টার কেনার টাকাও নেই বহু স্কুলে’ শীর্ষক প্রতিবেদন। ওই একই দিনে পাঁচের পাতার সংবাদ শিরোনাম ‘ট্যাবের গায়েব টাকা ফেরত: প্রক্রিয়া শুরু’। আটের পাতায় ছিল ‘বাংলা মাধ্যম স্কুলে উচ্চ প্রাথমিকের কাউন্সেলিংয়ে অনুপস্থিত শতাধিক’।‌ পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা অব্যবস্থার বহুমুখী এই সংবাদচিত্র ওই দিনেই চারের পাতায় প্রকাশিত সুকান্ত চৌধুরীর ‘কর্মনাশা হিসাবহীন’ প্রবন্ধে আরও স্পষ্ট ও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে।

পরিকাঠামোগত সমস্যা, শিক্ষক-শিক্ষিকা সংখ্যার ঘাটতি, শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের পড়ুয়ার অনুপস্থিতি নিয়ে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যমের অসম প্রতিযোগিতা চলে। সেখানে উল্লিখিত নির্ধারিত ব্যয় বরাদ্দের অনিয়মিত জোগান, প্রলম্বিত ছুটির আবহ, শিক্ষা উপকরণগুলির বণ্টনে দুর্নীতির যোগ বাস্তবে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের পচন, পতনের গতি বৃদ্ধি করে। এই আবহেই গত শতাব্দীর শুরু থেকে প্রতিটি অঞ্চলে ব্যক্তিগত ও সমবেত উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে অনেকগুলিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে অথবা হওয়ার মুখে।

রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে মুখ্যত এর দায় নিতে হবে। সঙ্গে রাজ্যের নাগরিকদের, সমাজ নির্মাণে নিয়োজিত বিভিন্ন অসরকারি প্রতিষ্ঠান, লেখক, কলাকুশলী, পত্রিকা, সাংস্কৃতিক সংস্থাকেও বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে হবে।‌ এই সরকারের সমর্থক, বিরোধী, সমালোচক— যে যার অবস্থানে থেকে সমবেত ভাবে এই দুরবস্থা দূরীকরণে সরব ও সক্রিয় হোক। নির্ভুল বাংলা বলতে পারা পড়ুয়ার সংখ্যা ক্রমশ কমে আসা, ভাষাজ্ঞানে অগভীরতা, সমাজ প্রতিষ্ঠায় এই ভাষাগোষ্ঠীর ব্যর্থতা এখনই বিপজ্জনক সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছে। পরবর্তী কালে এর পরিণতি বোঝা যাবে বাংলা পত্রপত্রিকার পাঠক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের দর্শক সংখ্যায় এবং সামাজিক অস্থিরতায়। সুতরাং, বিষয়টির গুরুত্ব শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে দরদি নাগরিক হিসাবে এ‌ সময়ে না বুঝলে অবশিষ্ট বিদ্যালয়গুলিও উঠে যাওয়ার সাক্ষী থাকতে হবে।

দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার পর যে ব্যাপক সংখ্যায় পড়ুয়ারা শিক্ষাছুট হচ্ছে, তার ফলে কলেজে স্নাতক স্তরে প্রচুর আসন ফাঁকা থাকছে। তাই কাদের কেন ট্যাব দেওয়া হবে, ট্যাব কতটা লেখাপড়ার কাজে লাগছে আর কতগুলো বাজারে ফেরত যাচ্ছে— তার ক্রমাগত মূল্যায়ন খুব জরুরি। উৎসব, অনুদান, না কি টানাটানির কোষাগারে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি— কোনটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন, স্থির করতে হবে।

সর্বোপরি, এই সমস্যার সমাধানে আমাদের নিজেদের এখনকার উদাসীনতা ত্যাগ করে উদ্যোগ করতে হবে শিক্ষার এই অন্ধকার অবস্থা থেকে আমাদের সমাজ কী ভাবে মুক্তি পেতে পারে সেই ভাবনার।

মানস দেব, কলকাতা-৩৬

অ-সহযোগিতা

‘চক-ডাস্টার কেনার টাকাও নেই বহু স্কুলে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পড়লাম। জানলাম ‘কম্পোজ়িট গ্রান্ট’ বাবদ স্কুলগুলির দৈনন্দিন খরচ চালানোর জন্য কেন্দ্র দেয় ৪০ শতাংশ এবং রাজ্য দেয় ৬০ শতাংশ। পড়ুয়ার সংখ্যার ভিত্তিতে স্কুলকে এই টাকা দেওয়া হয়। রাজ্যে পঞ্চায়েত দফতর পরিচালিত শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলিতেও এই টাকা ঢোকে। টিএল‌এম, অভিভাবক মিটিং ইত্যাদি বাবদ‌ও আলাদা আলাদা খাতে টাকা আসে। সেই খরচের টাকা অ্যাকাউন্ট থেকে তুলতে বা পেমেন্ট করতে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির স‌ই প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট অপারেটর হিসাবে মুখ্য সহায়িকা এবং কেন্দ্রের সম্পাদকের স‌ই লাগে চেকে। কেন্দ্রের সম্পাদক হন নির্দেশ অনুসারে কোথাও সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতের এগজ়িকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট, কোথাও পঞ্চায়েত সচিব অথবা সহায়ক। সুতরাং তাঁদের সবার স‌ই ছাড়া, অন্তত চেকে শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের টাকা তোলা বা কাজে লাগানো যায় না।

এমন অনেক স্কুল আছে যেখানে ম্যানেজিং কমিটি ও স্কুল সম্পাদক এই বিষয়ে কোনও রকম সহযোগিতা করতে চান না। উদাহরণ হিসাবে মুর্শিদাবাদ জেলার ন‌ওদা ব্লকের এমনই একটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের কথা বলা যায়। গত বছর ডিসেম্বরে এই কেন্দ্র প্রথম টিএল‌এম অঙ্কন হয়েছে। কিন্তু এখন‌ও অক্ষর শিল্পীকে পারিশ্রমিক দেওয়া যায়নি ম্যানেজিং কমিটি (পঞ্চায়েত সদস্য) এবং পঞ্চায়েতের এগজ়িকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট-এর স‌ইয়ের গড়িমসিতে। গত মার্চে ন‌ওদার বিডিওকে লিখিত ভাবে জানিয়েও কোনও কাজ হয়নি। অগত্যা নিজের বেতনের টাকা থেকেই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বিল-সহ স্কুলের দৈনন্দিন খরচ চালাতে হচ্ছে মুখ্য সহায়িকাকে।

সুতরাং কম্পোজ়িট গ্রান্ট বা স্কুল অ্যাকাউন্টে যে কোনও খাতের টাকা ঢুকুক বা না ঢুকুক কিছু আসে যায় না। সম্মিলিত সহযোগিতা ছাড়া সে টাকা স্কুলের কাজে লাগে না।

হামিম হোসেন মণ্ডল (বুলবুল), নওদা, মুর্শিদাবাদ

সংস্কারের দাবি

ট্যাব প্রকল্প, লক্ষ্মীর ভান্ডার, ‘শ্রী’ যুক্ত নানা প্রকল্প, আবাস যোজনা, কৃষকবন্ধু ইত্যাদি প্রকল্প এবং মেলা-খেলা-পুজো’সহ ধর্মীয় উৎসব-কার্নিভাল-উদ্বোধন ইত্যাদি সরকারি নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজ্যের নাগরিকের প্রতি আর্থিক অনুদান বেড়ে চলেছে। অথচ, এমন সরকারি অনুদান উপভোক্তা অনেক পরিবারেরই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ‘চক-ডাস্টার কেনার টাকাও নেই বহু স্কুলে’। এ-হেন চরম উদাসীনতা সবাই খালি চোখে দেখছেন, বুঝছেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল ভোটে তাঁদের জিতিয়ে কার্যত মেনেও নিচ্ছেন। আবার অন্য ভাবেও সমর্থন করছেন। যেমন, বড় পুজোর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

বর্ধমানে আমাদের পৈতৃক গ্রামে দাদা জানালেন, আবার একটা জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয়েছে। সেই গ্রামেই এক মাস আগে অন্তত ১০টা দুর্গাপুজো হয়েছে। এই নিয়ে সেখানে তিনটি জগদ্ধাত্রী পুজো হল। এ ছাড়া অন্নপূর্ণা, সরস্বতী, গাজন, নবান্ন সারা বছর লেগেই আছে। এ বার বন্যায় ধান, আখ ও অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সরকারি সহায়ক ক্রয়মূল্য ও উৎপাদকের অসহায় বিক্রয়মূল্যের দুষ্টচক্রে কৃষিকাজে লাভ দূরের কথা, উৎপাদনের মূল্যটুকুও ওঠে না। তা হলে এত পুজোর অর্থ কে দেয়, কারা কাজের ফাঁকে এত শ্রম দেয়? এই সরকারি সাহায্যের ভাল-মন্দ ও উপযোগিতা বিষয়ে গবেষণা হয়েই চলেছে, ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। কিন্তু এরই মাঝে যে শিক্ষাক্ষেত্র অশিক্ষা ও কুশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, সে বিষয়েও ভাবা প্রয়োজন।

বর্তমান শিক্ষানীতি নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। আবার শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত, মামলা, বিচার প্রক্রিয়াও দীর্ঘ হচ্ছে। এতে রাজ্যের রাজস্বের অপচয় হচ্ছে, রাজস্ব ব্যয় বেড়ে সরকারের ঋণ বাড়ছে, স্থায়ী সম্পদের জন্য পুঁজি বিনিয়োগের সম্ভাবনা আরও কমছে। এ সবে সরকার ও তার উপদেষ্টা, শাসক দলের রাজনীতি ও তার সমর্থক, বুদ্ধিজীবী— কারও নজর দেওয়ায় সময় নেই। ভয়ে বা ভক্তিতে, শিক্ষার সহযোগী সাহিত্য-সংস্কৃতি জগৎ এই নৈরাজ্য ও নেই-রাজ্য দেখেও নীরবে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে। বনিয়াদি শিক্ষার সুযোগ কমে যাচ্ছে। সরকারি স্কুলগুলি একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাসহায়ক সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি যে দ্রুততায় বাড়ছে, তা নিয়ে ভাবা প্র্যাকটিস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই হিসাব মিলছে না।

‘কর্মনাশা হিসাবহীন’ শীর্ষক সুকান্ত চৌধুরীর উত্তর সম্পাদকীয়টিতে বলা হয়েছে, গত বছর বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজ্য সরকার মহার্ঘ ভাতা কম দেয় বটে কিন্তু ছুটি দেয় প্রচুর। আসলে যত ছুটি বাড়বে, চক-ডাস্টার কম লাগবে। পড়ানো কমলে শিক্ষকের সংখ্যা, তাঁদের বেতন সবই কমবে। শিক্ষকরা চিকিৎসকদের মতো সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি তুলে আন্দোলন করলে হয়তো আলোর দিশা পাওয়া যেতে পারে।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

অন্য বিষয়গুলি:

Education Schools West Bengal government School students
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy