দুলাল শেখ। ছবি: লেখক
বাক্-শক্তিহীন অসুস্থ কবি নজরুল ইসলামের কাছে সর্বক্ষণ থাকা ও দেখভাল করার কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন দুলাল শেখ। তখন তিনি বেশ ছোট। নলহাটি থানার কয়থা গ্রামের এই লেখাপড়া না-জানা ছেলেটিকে কবিপুত্র কাজী সব্যসাচী তাঁর অসুস্থ পিতার পরিচর্যায়, স্ত্রী উমা কাজীকে সাহায্য করার জন্যই নিযুক্ত করেছিলেন। সেই দুলালই কবির শেষ জীবনের বেশ কয়েকটি বছর সর্বক্ষণের সেবক-সঙ্গী হিসাবে জীবন কাটিয়েছিলেন কবির সঙ্গে। মধুমেহ রোগাক্রান্ত কবিকে নিয়মমাফিক শিশুর মতো চামচ করে খাওয়ানো, স্নান করানো, পায়খানা-প্রস্রাব করানো সব কাজই করেছিলেন অক্লান্ত নিষ্ঠায়। রাতে কবির শয়নকক্ষে আলাদা একটি চৌকিতে দুলালের শোওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ক্রিস্টোফার রোডের সিআইটি বিল্ডিং-এর বাসভবনে এই বাংলায় জীবনের অন্তিম পর্বটি তখন কাটাচ্ছিলেন কবি নজরুল।
১৯৭১ সাল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। কলকাতাতেও তার আঁচ এসে লেগেছিল। রাতের আলো নিভিয়ে রাখা হত মাঝেমধ্যেই। তার পরে স্বাধীন হল বাংলাদেশ। কলকাতা জুড়ে হই-হুল্লোড়। কিছুদিন পরে নজরুল ইসলামের বাড়িতে কয়েক জন সঙ্গী-সহ এলেন মুজিবর রহমানের পুত্র শেখ মুস্তাফা কামাল। সব্যসাচীকে প্রস্তাব দিলেন কবিকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার। সব্যসাচী সরকারি স্তরে আলোচনার কথা বললেন। সেই মতো ঠিক হলো সব। দুলালকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। কয়থা গ্রামের যে ‘কালু মামা’-র মাধ্যমে নজরুল-পরিবারে কাজে ঢোকা দুলালের, তাঁর পান-সিগারেটের দোকান ছিল মৌলালির কাছে। কাজী সব্যসাচী তাঁর দোকান থেকে সিগারেট কিনতেন। বাড়ির কাজের জন্য একটি ছেলে জোগাড় করে দেওয়ার কথা কালু শেখকে তিনিই বলেছিলেন। কালু কয়থা থেকে তাঁর শাশুড়ির সঙ্গে কাজের খোঁজে আসা দুলালকে লাগিয়ে দিয়েছিলেন সে কাজে। দুলালদেরই প্রতিবেশী এই কালু শেখ সপরিবার কলকাতার কড়েয়া রোডে ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। কয়থা গ্রামের বাড়িতে দুলালের টাকা-পয়সা পাঠানো বা খোঁজ-খবর দেওয়ার কাজ তাঁর মাধ্যমেই চলত।
১৯৭১-এ সদ্য-স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে দু’দেশের মৈত্রীদূত হিসাবে কবিকে যখন ১৯৭২ সালের মে মাসে বিমানযোগে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়, তখন পরিবারের আরও পাঁচ জন সদস্যের সঙ্গে অনিবার্য সেবক-সঙ্গী হিসাবে গিয়েছিলেন দুলাল শেখও। বাড়ির রান্নার লোক কাটিয়া এবং আর এক বয়স্ক গৃহকর্মী কুশাকে কলকাতায় রেখেই যেতে হয়েছিল। অবশ্য দুলাল তখন আর বালক নন, তারুণ্য অতিক্রম করা যুবক। কবিপুত্র সব্যসাচী, পুত্রবধূ উমা, তাঁদের তিন সন্তান খিলখিল, মিষ্টি ও বাবুলদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কবির সাহচর্যে কাটানো দুলাল তখন হয়ে উঠেছেন ওই পরিবারেরই এক জন। এতটাই ঘরোয়া যে, পরিবারের সকলের বিমানের টিকিটগুলোও ছিল তাঁর কাছে রাখা। যার মধ্যে কয়েকটি টিকিট আজও, সেই সময়ের অমলিন স্মৃতি হিসেবে রাখা আছে তাঁর কাছে।
ঢাকায় গিয়ে ধানমন্ডির কবিভবনে বাংলাদেশ সরকার মঞ্জু ও মিলিতা নামের দু’জন নার্সকে কবির সেবাকর্মে নিযুক্ত করলেও, ছায়াসঙ্গী হিসাবে দুলালকে থাকতে হত সেখানেও। কবির শয়নকক্ষেই বিছানা পাতা হয়েছিল দুলালের।
অথচ, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! কবির জীবনের শেষ সময়টিতে তাঁর পাশে আর থাকা হয়নি দুলালের। সেই কবে ঘর ছেড়ে আসার পরে, অসুস্থ কবিকে রেখে যাঁর এক দিনও ফেরা হয়নি নিজের বাড়িতে, মায়ের গুরুতর অসুস্থতার খবরে সেই দুলালকেই ফিরতে হয়েছিল বীরভূমের কয়থায়, সেটা ১৯৭৪-এর কোনও এক দিন। মাস কয়েকের মধ্যেই মা হালেমা বিবির মৃত্যু হয়েছিল। দুলালের পাঠানো টাকা যদিও পৌঁছে যেত বাড়িতে, তবু ছোট ভাইবোনগুলোকে রেখে তাঁর বড় ছেলে আবার ঘর ছাড়ুক, বৃদ্ধ বাবা মোফেজ শেখ হয়তো সেটা চাননি। ছেলেকে সংসারের বাঁধনে জড়িয়ে দিতে মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম থানার আতাই গ্রামের মাসতুতো বোন ফরিদা বিবির সঙ্গে দুলালের বিয়ে দিয়ে দেন। তার পরে বাবাও বেশি দিন বাঁচেননি।
নিজের বিয়ে ও বাবার মৃত্যুর মতো ঘটনার ফাঁদে আটকা পড়ে ফেরার কথা থাকলেও দুলালের আর ফেরা হয়নি ঢাকায়। বাবা নেই, বাড়িতে ছোট ভাইবোন। সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীও কোনও মতেই রাজি হলেন না ঢাকা যেতে। তার পরে এল ১৯৭৬-এর ২৯ অগস্টের সেই বেদনাময় দিনটি। ঢাকায় প্রয়াত হলেন বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম। রেডিও-তে কবির মৃত্যুর সংবাদ শুনে নলহাটি স্টেশনে শিশুর মতো সেদিন কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন দুলাল। তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন স্টেশনে জড়ো হওয়া হকারেরা এবং আজিমগঞ্জ লাইনের হকার-ইউনিয়ানের নেতা সমর দাস। দুলাল তখন ট্রেনে হকারি করেই সংসার চালাচ্ছেন। টিনের বাক্সে ঝুরিভাজা ভরে বিক্রি করেন। সমর দাস জানতেন, বিদ্রোহী কবির কাছে দুলালের দীর্ঘদিন থাকার কথা। মাঝেমধ্যে দুলালকে গালমন্দও করতেন, কবির সাহচর্য ছেড়ে চলে আসার মতো ‘মস্ত বড় ভুল’ করার জন্য।
কবি নজরুলের প্রয়াণের পরেই দুলাল শেখ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন কবি-পরিবার থেকে। দারিদ্রপীড়িত জীবনে এর পরে শুধুই সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে তাঁকে। ভাইবোনদের মানুষ করা, স্ত্রীকে নিয়ে পারিবারিক অশান্তি। সবশেষে শান্তি ফেরাতে স্ত্রীর দাবি মেনে নিজের পিতৃভূমি কয়থা ছেড়ে শ্বশুরালয় মুর্শিদাবাদের আতাই গ্রামে গিয়ে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করা। জীবনসংগ্রামের জাঁতাকলে পিষ্ট দুলালের আর পিছু ফিরে অতীতকে দেখার সুযোগ হয়নি। দুলাল শেখের স্মৃতিচারণের সূত্রেই জানা যায়, আলিপুর হাসপাতালের চিকিৎসক অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় আসতেন কবির স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য। কবির গুণগ্রাহী বিশিষ্ট মানুষজনও আসতেন সময়ে সময়ে। গানও শোনানো হতো কবিকে। তবে, পছন্দের গান না হলে, বা বেসুরে গাইলেই কবি খানিক উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। তখন পাল্টাতে হত গান। পছন্দের গানে নিজের হাঁটুতে হাতের টোকা মেরে তাল দিতেন নজরুল ইসলাম। এ সবই খুব কাছে বসে দেখা দুলালের। যাঁরা সে সময় আসতেন কবির কাছে, তাঁরা দুলালের হাতে দু-এক টাকা দিয়েও যেতেন। মাঝে মাঝে চুরুলিয়া থেকে ওই বাড়িতে যেতেন কবির ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী মোজাহার হোসেন। তাঁর সঙ্গী হিসাবে খুড়তুতো ভাইও যেতেন, যিনি পরিচিত ছিলেন হাঁদু কাজী নামে। তাঁরা থাকতেনও কলকাতায় গিয়ে।
গৃহকর্ত্রী উমা কাজীর তত্ত্বাবধানে কাজে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই, কবির সুবিধা-অসুবিধার দেখভাল এবং বিশেষ ভাবে তাঁকে খাওয়ানোর কৌশল রপ্ত করে নিয়েছিলেন দুলাল। সকালে উমা কাজীর গুলে দেওয়া হরলিক্স এবং একটু বেলা হলে ভেজা চিঁড়ে কলা মাখিয়ে চামচ দিয়ে খাওয়াতে হত কবিকে। ডায়াবিটিস থাকায় চিনি দেওয়া হত না। দুপুরে ভাতের সঙ্গে ডাল চটকে স্টু-এর মতো করতে হত। সঙ্গে হালকা মাছের ঝোল। বিকেলে চায়ে ভেজানো বিস্কুট কিংবা দুধ-পাউরুটি। এ সবই দুলালের স্মৃতিচারণে উঠে আসা তথ্য। খাওয়ার বিষয়ে নজরুল আপত্তি করতেন না। খাওয়ার আর ইচ্ছা না থাকলে, অনিচ্ছাটা তাঁর মুখভঙ্গিতেই বোঝা যেত। দুপুরে ঘুমোতেন কবি। কোনও কোনও সময় বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে টলোটলো পায়ে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াতেন। বিভোর হয়ে বাইরের সব কিছু দেখতেন। কলকাতার বাড়িতে কবি একেবারে চলচ্ছক্তিহীন ছিলেন না। কারও একটু সাহায্য পেলেই হাঁটতে পারতেন।
লেখক : কয়থা হাইস্কুলের শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy