Advertisement
E-Paper

উৎসবের নামে আস্ফালন

মুসলমান, খ্রিস্টান অথবা অন্য সংখ্যালঘু মানুষকে জোর করে হোলির রং মাখানো শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্ফালন নয়— সংবিধানের অবমাননা।

শান্তিলতা গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৫ ০৫:৩০
Share
Save

দোল গেল সবে। বাঙালির দোল মানে বসন্ত উৎসব। বাংলার বাইরে দোল হোলি হ্যায়। দোল, বসন্ত উৎসব বা হোলি যে নামেই ডাকি না কেন, এ উৎসব মূলত হিন্দুর উৎসব। হিন্দু ভারতীয় ওই দিন রং খেলে, ফুর্তি করে। নাচগানও করে। ভাল কথা। কিন্তু হিন্দুর উৎসব মানেই সমস্ত ভারতীয়ের উৎসব— এ কথা কোথায় কী করে ঠিক হল? আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী সব সম্প্রদায়ের মানুষের উৎসব পালনের এবং চয়নের অধিকার আছে। অ-হিন্দু মানুষ দোল পালনে শামিল হবেন কি না, সেটা তাঁদের পছন্দের বিষয়। মুসলমান, খ্রিস্টান অথবা অন্য সংখ্যালঘু মানুষকে জোর করে হোলির রং মাখানো শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্ফালন নয়— সংবিধানের অবমাননা।

সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন শহরে এবং দেশ জুড়ে রমজান মাসের শুক্রবারে দোল হওয়ার কারণে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের উপর যে হুমকি ও নির্যাতন দেখা গেল, তা এ-দেশে গত এক দশক ধরে ঘটে চলা হিন্দুত্ববাদী হিংসার নগ্ন প্রকাশ। উন্নাও শহরে রং নিতে আপত্তি করার জন্য হিন্দু প্রতিবেশীদের হাতে হত্যা হতে হল শরিফকে।

সংখ্যাগরিষ্ঠের উৎসব যখন সংখ্যালঘু্র কাছে ভয়ের কারণ হয়ে ওঠে তখন দেশের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। গত কয়েক বছর ধরে রামনবমীতে যে-ভাবে মসজিদের আশপাশে, মুসলিম পাড়ায় হিন্দুত্বের তাণ্ডব দেখা গেছে, তারই প্রসার দেখা গেল এ বার দোলে। সব থেকে দুশ্চিন্তার বিষয় হল যে, পুলিশ উত্তরপ্রদেশের সম্ভল শহরের অন্যতম প্রধান মসজিদ জামা মসজিদ-সহ দশটি মসজিদ প্লাস্টিক অথবা টারপলিন দিয়ে ঢেকে রাখার কথা ঘোষণা করে এবং দোলের দিন তা করেও। এক পদস্থ পুলিশ অফিসার মুসলমান নাগরিকদের দোলের দিন বাড়ির ভিতরে থাকার ‘পরামর্শ’ দেন। প্রশ্ন হল, দেশের আইন-রক্ষক কী ভাবে শান্তি রক্ষার নামে সংখ্যালঘু মানুষের চলাফেরার, ধর্মীয় আচার পালনের অধিকার খর্ব করেন? সম্প্রদায় নির্বিশেষে নাগরিকের গতিবিধির অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার সুরক্ষিত রাখা পুলিশের কর্তব্য। তা হলে কি ধরে নিতে হবে এ ক্ষেত্রে নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ পুলিশ?

একটি বহুল প্রচারিত ভালমন্দের ধারণার কথা মনে পড়ল। আমাদের সমাজ, মানে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজ, ‘ভাল মুসলমান’ ও ‘খারাপ মুসলমান’ নামে দুই ধরনের মুসলমানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। ‘খারাপ মুসলমান’ তাঁরা যাঁরা নিজের ধর্মীয় আচার-আচরণে স্থিত থাকতে পছন্দ করেন এবং হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যের কাছে মাথা নত করেন না। আর তাঁরাই ‘ভাল মুসলমান’ যাঁরা সরস্বতী পুজোয় ফল কাটতে আসেন সানন্দে, কিন্তু তাঁদের ইদকে আমরা উৎসবের মান্যতা না দিলেও মাথা নিচু করে অপমান হজম করতে বাধ্য হন।

প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগের একটি বিজ্ঞাপন মনে পড়ছে। দোলের অনুষঙ্গে তৈরি সেই বিজ্ঞাপনে দেখা যায় যে, এক হিন্দু ও এক মুসলমান দম্পতির দোলের দিন মুখোমুখি দেখা হয়েছে। হিন্দু পুরুষ ভারী ‘সজ্জন’ মুখে মুসলমান পুরুষকে দোলে আবির লাগাতে চান এবং মুসলমান পুরুষের রাগী অভিব্যক্তি পর্দায় ভেসে ওঠে। অর্থাৎ আদতে এই মুসলমান যুবক ‘খারাপ মুসলমান’। কিন্তু যে-হেতু বিজ্ঞাপনটিকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বানাতে হবে, তাই মুসলমান যুবকের অভিব্যক্তি ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়, আর সে হিন্দু যুবকের আবির গ্রহণ করে।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ধর্মনিরপেক্ষতার দায় কেন সর্বদা সংখ্যালঘুকেই নিতে হবে? কেন বিজ্ঞাপনে হিন্দু যুবক নিজেকে রং মাখানো থেকে নিরস্ত করে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রমাণ করে না? আসলে গত কয়েক দশকে আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটির ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। সংখ্যালঘুর সুরক্ষার বদলে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ এখন দাঁড়িয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে একমেবাদ্বিতীয়ম্ করে তোলা। তাই আজ আমাদের দেশে পুলিশ-প্রশাসন নির্দেশ দেয় যে দোলে, রামনবমীতে, বা অন্যান্য হিন্দু পার্বণে মুসলমান মহল্লায়, মসজিদ ঘিরে হিন্দুর ঢোল-করতাল বাজবে এবং মুসলমানকে নমাজ বন্ধ করে ঘরে থাকতে হবে!

শুধুমাত্র রাষ্ট্র নয়, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, আমাদের নাগরিক সমাজও এখন হিন্দু আধিপত্যবাদের কবলে। সম্প্রতি কলকাতায় ঘটে যাওয়া পড়ুয়া-ডাক্তারের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সারা শহর প্রতিবাদে পা মেলান। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই দেখা যায়, এই আন্দোলন প্রধানত হিন্দু উচ্চবর্গীয় নারী-পুরুষের দ্বারা পরিচালিত এবং এই আন্দোলনে প্রতিবাদের ধরনে শঙ্খ, দুর্গার ছবি ইত্যাদি ব্যবহৃত হচ্ছে। নারী-নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনে হিন্দু ধর্মের প্রতীক ব্যবহার শুধুমাত্র সংখ্যালঘু মানুষকে প্রতিবাদ-মঞ্চে ব্রাত্য করে না, প্রচ্ছন্ন ভাবে, হিন্দু আধিপত্যেরও সাক্ষ্য বহন করে। এই প্রসঙ্গেই নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়ে আর একটি প্রশ্ন ওঠে। যে নাগরিক সমাজ সঙ্গত ভাবেই নির্ভয়া থেকে অভয়ার জন্য বিচার চেয়ে প্রতিবাদে মুখর হয়, সেই নাগরিক সমাজ সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতনে নীরব কেন? এ ক্ষেত্রে কেন সব সময় নির্যাতিতকেই প্রতিবাদের দায় নিতে হয়?

শুধুমাত্র সংখ্যালঘু নয়। মথুরা, ফরাক্কাবাদের দলিত সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষের উপরেও উচ্চবর্ণের পুরুষ জোর করে রং মাখাতে যায়, এবং সেই সম্প্রদায়ের হোলি পালনে বাধার সৃষ্টি করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলিত মানুষের উপর গুলি চলার অভিযোগও শোনা যায়। চিন্তার কথা দুটো। এক দিকে হিন্দু উৎসব ঘিরে আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদের জুলুম ক্রমশই বাড়ছে। অন্য দিকে, শরিফের মৃত্যু আমাদের মতো মানুষের মনে তেমন আলোড়ন তুলতে পারছে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Holi Indian Constitution

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}