Advertisement
E-Paper

বিরোধ নয়, সহমর্মিতা

যোগী আদিত্যনাথের অর্ধকুম্ভকে কুম্ভ এবং পূর্ণকুম্ভকে মহাকুম্ভ হিসাবে ‘রিব্র্যান্ডিং’, ১৪৪ বছরের গ্রহ-নক্ষত্রের যোগকে কেন্দ্র করে বিপুল প্রচারের পাশাপাশি সমাজমাধ্যমে ‘ট্রেন্ড’ তৈরি করার খেলা।

শ্রীমন্তী রায়

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৫ ০৫:১৮
Share
Save

ভেবে দেখলাম, এ বার বোধ হয় আমি ছাড়া আর সবাই কুম্ভস্নান করে এসেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় একের পর এক ভেসে আসছে পোস্ট— কেউ কুম্ভে ডুব দিয়ে তার ছবি আপলোড করছেন, কেউ আবার জানাচ্ছেন বিবিধ সুবন্দোবস্তের কথা। কেউ কেউ অবশ্য অব্যবস্থা নিয়েও অভিযোগ জানিয়েছেন— কিন্তু, জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ অবধি সব পথই বোধ হয় ইলাহাবাদ, থুড়ি প্রয়াগরাজ হয়ে গেল।

সত্যিই গেল, না কি যাচ্ছে বলে দেখানো হল, সে প্রশ্নও অবশ্য থাকছে। এ বারের কুম্ভ দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিপণনী খেলার প্রতিভার সাক্ষী হয়ে থাকল। যোগী আদিত্যনাথের অর্ধকুম্ভকে কুম্ভ এবং পূর্ণকুম্ভকে মহাকুম্ভ হিসাবে ‘রিব্র্যান্ডিং’, ১৪৪ বছরের গ্রহ-নক্ষত্রের যোগকে কেন্দ্র করে বিপুল প্রচারের পাশাপাশি সমাজমাধ্যমে ‘ট্রেন্ড’ তৈরি করার খেলা। এক বার ট্রেন্ড তৈরি হলে তার পর তা নিজের জোরেই চলতে থাকে— ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের দেখাদেখি সবাই ডুব দিতে চান চলতি প্রবণতার জলে। তাতে মেলায় পদপিষ্ট হতে হলেই বা কী, গঙ্গার জলের দূষণ সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেই বা কী, প্রয়াগরাজের পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকলেই বা কী! ২০২৫-এর ভারত দেখল, ধর্মকে কেন্দ্র করে ‘যুক্তিহীন উন্মাদনা’ কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে।

কিন্তু, আসমুদ্রহিমাচল ভারতের যে কোটি কোটি মানুষ পৌঁছে গেলেন কুম্ভে, তাঁরা সবাই কি শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার স্রোতে গা ভাসাতে গেলেন? কুম্ভের রাজনৈতিক বিপণনে মজে গিয়ে কিনে ফেললেন যোগী ব্র্যান্ডের হিন্দুত্ব? যাঁরা ধর্মে বিশ্বাস করেন, তাঁরা কি প্রত্যেকেই ডুবে রয়েছেন অন্ধকারে— প্রকৃত বিজ্ঞান চেতনার আলোই একমাত্র তাঁদের উদ্ধার করতে পারে সেই তমসা থেকে? যাঁরা নিজেদের ‘যুক্তিবাদী’ বলে মনে করেন, তাঁরা অনেকেই হতাশ হয়ে, রেগে গিয়ে, ব্যঙ্গ করে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণকে ‘ধর্মান্ধ’ বলে অভিহিত করছেন। তাতে অবশ্য লাভের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি।

এটা মেনে নেওয়া খুব জরুরি যে, ভারত‌ের ইতিহাসে ধর্ম এক বিশেষ স্থান অধিকার করে ছিল, আছে, এবং থাকবে। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ ভয়ানক নিরাপত্তাহীন, আশঙ্কায় ভরা জীবনে ধর্মকে ভিত্তি করে এক নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সেই আশ্রয়ই তার কাছে ঈশ্বর— ঈশ্বর খোঁজার পন্থা হিসাবে সে বেছে নিয়েছে ভক্তি নামক নিবেদনের রাস্তাকে। এই ভক্তি কোনও বিশেষ ক্ষমতার চাপানো ভক্তি নয়, এর সঙ্গে জড়িত থাকে গভীর মনস্তত্ত্ব। শুধুমাত্র যুক্তির সাহায্যে এর ব্যাখা করা অসম্ভব, কারণ এর সঙ্গে কল্পনারও যোগ আছে— আমরা নিজেদের মনের সাপেক্ষে এক জনকে গড়ে তুলেছি, যার কাছে আমরা নির্দ্বিধায় নিজেদের দুঃখ, ক্ষোভ, চাহিদা এই সব কিছু বলতে পারি। আমার আকাঙ্ক্ষা-নির্মিত এই মূর্তিকেই আমি সর্বশক্তিমান মনে করছি, বিশ্বাস করছি যে, সে আমাকে রক্ষা করবে, এই চিন্তা আমাকে মানসিক জোর দিচ্ছে , আমি তার কাছে নিজের যন্ত্রণার কথা বলতে পেরে মানসিক তৃপ্তি লাভ করছি। শুধু তা-ই নয়, এই ঈশ্বর চেতনা, ধর্মবোধ আমাকে নৈতিকতার পাঠও দিচ্ছে। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত ধর্ম আমাদের কাছে নৈতিকতার কম্পাসবিশেষ।

সমস্যা হল, রোজকার জীবনে আমরা ঈশ্বরের কৃপাপ্রার্থী হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু আচরণ অভ্যাস করি— আমাদের অধিকাংশের কাছেই ধর্ম আসলে আদর্শের চেয়ে বেশি নিয়মকেন্দ্রিক— সেই নিয়মগুলো আসছে কোথা থেকে? কে বলে দিচ্ছে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর রাস্তা? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরোহিত, মৌলবি, যাজকরা সেই পথ দেখান। এই বিন্দুটিতে পৌঁছে আমি আমার আর ঈশ্বরের মধ্যে আর এক জনকে প্রবেশাধিকার দিচ্ছি— তাঁকে বা তাঁদের কোনও প্রশ্ন করছি না, নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করছি, কারণ আমি মনে করছি তাঁরা ধর্মগ্রন্থ, শাস্ত্রের যে ব্যাখ্যা করছেন, কিংবা যে মন্দির, মসজিদ, চার্চের তাঁরা অংশ তা তাঁদেরকে এক ধরনের ক্ষমতা দিচ্ছে ধর্মীয় ক্ষেত্রে ‘উচ্চতর’ হওয়ার।

অর্থাৎ, এখানে পৌঁছে ধর্ম আর ‘ব্যক্তিগত’ থাকছে না, তা হয়ে উঠছে কিছু পূর্বনির্ধারিত ধর্মাচরণ পালনের অভ্যাস। তার নিয়ন্ত্রণ কখনওই সাধারণ মানুষের হাতে ছিল না— তা বরাবরই নিয়ন্ত্রণ করছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বা ধর্মগুরুরা। এই প্রাতিষ্ঠানিকতার চক্রব্যূহে উপলক্ষ আসল বস্তুকে স্বভাবতই ছাপিয়ে গেছে— ধর্মীয় আদর্শের চেয়ে ধর্মীয় অনুশাসন, আচার প্রবলতর হয়েছে। তার সঙ্গে রাজনীতি আর রাষ্ট্রক্ষমতার মিশেলে তৈরি করেছে শ্রেষ্ঠত্বের এক অলীক বোধ। যে ধর্ম আমাকে ‘আশ্রয়’ দিচ্ছিল, নৈতিকতার পাঠ শেখাচ্ছিল তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আমাকে খণ্ডীকরণের ভাবনায় এগিয়ে দিচ্ছে।

তবু, সেটাই শেষ নয়। ভারতে অধিকাংশ সময়েই ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতির চিহ্নগুলির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে, এমন ভাবে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে যে, সব সময় এই দু’টিকে আলাদা করা যায় না। আমরা অধিকাংশই কিন্তু ধর্মকে চিনি কতকগুলি আচরণের মাধ্যমে, কতকগুলি বিশ্বাসের মাধ্যমে; সেই আচরণগুলি, বিশ্বাসগুলি ছোট থেকেই আমার মধ্যে জারিত হতে থাকে— এবং ক্রমে ক্রমে আমার যাপনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়— এর মধ্যে দিয়ে আমাদের একটা আত্মপরিচিতি গড়ে ওঠে। ফলে সেই আচরণগুলি, যা অধিকাংশই ধর্মীয়, তা বহু কাল ধরে পালন করার দরুন তা হয়ে ওঠে সংস্কৃতি।

এই আচার পালন, সংস্কৃতির চিহ্ন বহন, এই সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে স্মৃতি। আমরা যে ধর্মাচরণের বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনও প্রশ্ন করি না— বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিই— তার পিছনে আমাদের স্মৃতির ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্মৃতির উপর ভিত্তি করেই আমরা ব্যক্তিগত আর সমষ্টিগত সত্তা গড়ে তুলি, স্মৃতিগুলোর পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করি— কারণ ওইগুলো আমার আত্মপরিচয়ের অংশ হয়ে ওঠে। আমার পৈতে হয়েছিল, আমার ছেলের হবে না? অথবা, আমি মহালয়ার দিন বাবার সঙ্গে তর্পণ করতে যেতাম, আমিও সেই ভাবে আমার সন্তানদের নিয়ে যেতে চাই; আমার বাবা ইদের দিন বড় মসজিদে নমাজ পড়তে যেতেন, আমিও তাই ওখানেই যাই। কোনটা ধর্ম, কোনটা সংস্কৃতি আর কোনটা নিতান্ত অভ্যাস, ফারাক করা মুশকিল, তাই না?

ফলে ধর্মান্ধতার বিরোধিতা করতে গিয়ে যদি এই সমস্ত চেতনাকে আঘাত করতে শুরু করি, তা হলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যে মেয়েটি তার মায়ের স্মৃতি শিরোধার্য করে দশমীর দিন সিঁদুর খেলে মণ্ডপে, তাকে নিশ্চয়ই বোঝাতে হবে সেই প্রথার মধ্যে নিহিত পুরুষতন্ত্রের আখ্যানটি— কিন্তু, তাকে আঘাত করলে সে আরও বেশি আশ্রয় খুঁজবে তার চেনার ছকের মধ্যেই, কারণ সেই ছকটি তার আত্মপরিচয়ের অঙ্গ। নিজেকে প্রশ্ন করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে ঠিকই, কিন্তু তার জন্য ধৈর্য প্রয়োজন, সহনশীলতা প্রয়োজন— এবং, সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উল্টো দিকে থাকা মানুষটির বিশ্বাসকে মর্যাদা দেওয়ার অভ্যাস।

ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতির খেলায় যাঁরা বিরক্ত, তাঁদের সেই বিরক্তি, রাগ, অসহায়তা শিরোধার্য। কিন্তু, কার উপরে বিরক্ত হব, সে কথাটিও ভুললে চলবে না। ধর্মকে যাঁরা রাজনীতির হাতিয়ার করে তোলেন, আর যাঁদের স্মৃতি-সত্তায় ধর্মের অভ্যাস মিশে থাকে জল-হাওয়ার মতো, তাঁরা কিন্তু এক নন। প্রথম গোষ্ঠীর কারণে তৈরি হওয়া বিরক্তি দ্বিতীয় গোষ্ঠীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে মস্ত ভুল হবে। কুম্ভকে যাঁরা রাজনীতির মেলায় পরিণত করলেন, আর শত কষ্ট সয়েও সেই কুম্ভে যাঁরা স্নান করতে গেলেন, দুই দলকে আলাদা ভাবে দেখতেই হবে। মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় গোষ্ঠীর মানুষদের বাদ দিলে ভারত নামক দেশটিই হয় না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kumbh Kumbh Mela Politics Religious

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}