মোট ২৯টি শ্রম আইনকে গেঁথে ফেলা হল চারটি শ্রম বিধিতে। প্রথমটি বেতন সংক্রান্ত বিধি, দ্বিতীয়টি শিল্পসম্পর্ক সংক্রান্ত বিধি, তৃতীয়টি কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিধি এবং চতুর্থটি সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধি।
শ্রম আইনকে সরল এবং আধুনিক করে তোলাই এই সংস্কারের উদ্দেশ্য। শ্রম আইন সংস্কারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল, শ্রমিকের স্বার্থরক্ষা করেও কী ভাবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যায়, তা নিশ্চিত করা। কোন সংস্থা শ্রম আইনের অধীনে আসবে, কত জন শ্রমিক থাকলে ছাঁটাইয়ের আগে অনুমতি নিতে হবে, কী ভাবে শ্রম আইন মোতায়েন করা যাবে, কী ভাবে শ্রমশক্তিকে আরও নমনীয় করা যাবে, এবং কী ভাবে শ্রমিকদের গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়ানো যাবে, শ্রম আইন সংক্রান্ত বিতর্ক মূলত এই প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করেই চলে। শ্রম আইন যাতে সরল হয়, সময়ের দাবি মেনে পাল্টায়, তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত সংস্কারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
২০০২ সালের জুন মাসে জাতীয় শ্রম কমিশন সুপারিশ করেছিল, যে সব শ্রম আইন আছে, সেগুলিকে একত্র করা হোক। কমিশন উল্লেখ করেছিল যে, কেন্দ্র এবং রাজ্য, উভয় স্তরেই বহু শ্রম আইন চালু আছে। এবং, অধিকাংশ শ্রম আইন তৈরি করার সময় সামগ্রিক ছবিটার কথা ভাবা হয়নি, ফলে সেগুলির মধ্যে একটা বহুবিধ জটিলতা ও গরমিল থেকে গিয়েছে— সংজ্ঞার ফারাক, বহু প্রাচীন শর্ত ইত্যাদি। কমিশন জানিয়েছিল, খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু শব্দের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনের সংজ্ঞা বিভিন্ন হওয়ায় তার ব্যাখ্যাও পৃথক হয়ে যায়।
কমিশন সুপারিশ করেছিল যে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং সমতা আনার জন্য শ্রম আইনগুলিকে সরল করা প্রয়োজন, এবং সেগুলিকে কয়েকটি গুচ্ছে সংগঠিত করা প্রয়োজন। যেহেতু বিভিন্ন শ্রম আইন বিভিন্ন মাপের প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন শ্রেণির কর্মীদের জন্য প্রযোজ্য, ফলে সেগুলিকে গুছিয়ে আনলে অনেক বেশি সংখ্যক শ্রমিককে এই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। কমিশনের সুপারিশ অনুসারেই সংসদে শ্রমিকদের বেতন, শিল্পসম্পর্ক, সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধিগুলি সংসদে পেশ করা হয়েছিল।
এই নতুন বিধিতে বলা হয়েছে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী এবং ‘গিগ ওয়ার্কার’ ও ‘প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কার’ মিলিয়ে মোট ৪০ কোটি কর্মীর জন্য একটি সামাজিক সুরক্ষা তহবিল গঠন করা হবে, এবং সেই টাকায় তাঁদের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়ি, অর্থাৎ অস্থায়ী শ্রমিকদেরও স্থায়ী শ্রমিকদের সমান চাকরির সুবিধা দিতে হবে— গ্র্যাচুইটি, ছুটি এবং সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নে দুই শ্রেণির শ্রমিকের মধ্যে কোনও পার্থক্য রাখা যাবে না। শিল্পক্ষেত্রে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে জরিমানার ৫০ শতাংশ পাবেন ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা, সঙ্গে তাঁদের বকেয়াও মিটিয়ে দিতে হবে।
কাজের পরিবেশে নিরাপত্তাকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে ন্যাশনাল অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ বোর্ড তৈরি করা হবে। গিগ শ্রমিক, প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের সঙ্গে চা-বাগিচার শ্রমিকদেরও ইএসআই-এর সুবিধার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সব পরিযায়ী শ্রমিককেই শ্রম আইনের আওতায় আনা হচ্ছে— এই আইনের মাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকদের দক্ষতার বিবরণ নথিভুক্ত হবে ও বিভিন্ন সরকারি কাজেও তাঁদের কর্মসংস্থানের চেষ্টা করা হবে। পরিযায়ী শ্রমিকদের বছরে এক বার বাড়ি যাওয়ার জন্য ভাতা দিতে হবে নিয়োগকর্তাদের।
এত দিন আরও অভিযোগ ছিল, শ্রম আইনের জটিলতার ফলে এক দিকে যেমন সংস্থার খরচ বাড়ে, অন্য দিকে তাতে শ্রমিকেরও খুব একটা লাভ হয় না। আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা দিব্য তৈরি করে নেওয়া যায়, তাতে শুধু ইনস্পেক্টরদের পকেট ভরে। শ্রমবিধি চালু হলে প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ হবে, একটিই রেজিস্ট্রেশন, একটিই লাইসেন্স, এবং সব বিধির জন্য একটিই রিটার্ন প্রয়োজন হবে। ইনস্পেক্টরদের নতুন ভূমিকায় যোগ হবে ফেসিলিটেটরের দায়িত্ব, নজরদারির কাজটি হবে মূলত ওয়েবনির্ভর। তার ফলে লাইসেন্স রাজ-এর প্রকোপ কমবে বলেই আশা করা যায়।
প্রশ্নও অবশ্য অনেক। এখন চুক্তিশ্রমিকদের ক্ষেত্রে যে নিয়মগুলি আছে, তা প্রযোজ্য কারখানায় কর্মী-সংখ্যা অন্তত কুড়ি জন হলে। নতুন শ্রমবিধিতে সেই সীমাটি পঞ্চাশ করা হয়েছে। কর্মী ছাঁটাই করার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এত দিন নিয়ম ছিল, সংস্থায় কর্মীর সংখ্যা ১০০ জন হলেই তা বন্ধ করার আগে, বা শ্রমিক ছাঁটাই করার আগে সরকারের অনুমতি নিতে হত। এই নিয়মটি নিয়ে সবচেয়ে বড় আপত্তি ছিল এই যে, এর ফলে বাজারে চাহিদা কম থাকলে সেই অনুযায়ী উৎপাদন কমানোর সময় কর্মী ছাঁটাই করা যায় না। নতুন শ্রমবিধিতে নিয়ম হয়েছে, সংস্থায় কর্মী-সংখ্যা অন্তত ৩০০ হলে তবেই ছাঁটাইয়ের আগে অনুমতি নিতে হবে। এবং, প্রয়োজন অনুসারে সরকার এই সংখ্যাটিকে আরও বাড়াতে পারে, শুধু বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে।
শিল্পসম্পর্ক সংক্রান্ত বিধিতে ঠিকা শ্রমিকের একটি নতুন ধরন তৈরি হয়েছে— তার নাম ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট বা নির্দিষ্ট মেয়াদের নিয়োগ। ২০১৮ সাল থেকেই অবশ্য এই ব্যবস্থা চলছে। এই ধরনের চাকরিতে নিয়োগকর্তা ও কর্মীর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য চুক্তি হয়। এতে নিয়োগকর্তার সুবিধে— বাজারে সাময়িক ভাবে চাহিদা তৈরি হলে, পাকাপাকি ভাবে সংস্থার কর্মী-সংখ্যা না বাড়িয়েও অল্প দিনের জন্য বাড়তি লোক নিয়োগ করা যায়। প্রচলিত ঠিকা শ্রমিকের তুলনায় এই নির্দিষ্ট মেয়াদের শ্রমিকদের প্রাপ্য সুযোগসুবিধার পরিমাণ বেশি। কিন্তু প্রশ্ন থাকছে, যেহেতু এই ধরনের চাকরি নির্ভর করে নিয়োগকর্তার মর্জির ওপর, এই শ্রমিকরা নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে সরব হতে পারবেন না।
একটা যুক্তিযুক্ত আপত্তি হল, কোনও সংস্থায় যদি অনেক শ্রমিক সংগঠন থাকে, তবে তা শেষ অবধি শ্রমিকদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়— কারণ, সব সংগঠনের সঙ্গে কোনও সমঝোতায় পৌঁছনো বিভিন্ন কারণে প্রায় অসম্ভব। নতুন শিল্পসম্পর্ক বিধিতে কোনও শ্রমিক সংগঠনকে স্বীকৃতি দেওয়ার নতুন শর্ত তৈরি করা হয়েছে। ঠিক হয়েছে, যদি সংস্থার অন্তত ৫১ শতাংশ শ্রমিক কোনও সংগঠনের সদস্য হন, একমাত্র তবেই সেই সংগঠনকে ‘নেগোসিয়েশন ইউনিয়ন’-এর স্বীকৃতি দেওয়া হবে, অর্থাৎ সংগঠনটি শ্রমিকদের প্রতিনিধি হিসেবে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারবে। যদি কোনও সংগঠনই সেই শর্ত পূরণ না করতে পারে, তা হলে নেগোসিয়েশন কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে। তবে, স্বীকৃত শ্রমিক সংগঠন নির্বাচন করার পদ্ধতি কী হবে, নতুন শ্রমবিধিতে তা বলা হয়নি। তা ছাড়াও নিয়ম হয়েছে, কারখানায় হরতাল ঘোষণা করার জন্য দু’সপ্তাহের নোটিস দিতে হবে।
বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংসদকে এড়িয়ে নিয়ম তৈরির অধিকার সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প কী ভাবে প্রযোজ্য হবে, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার বিধির কী হবে, তা নির্দিষ্ট হয়নি। সরকার সেই সিদ্ধান্ত নেবে। কারখানায় শ্রমিকসংখ্যা কত হলে ছাঁটাই করার জন্য সরকারের অনুমতি নিতে হবে, সেই সীমাটি বাড়াবার অধিকারও যেমন সরকারের হাতে, ন্যূনতম বেতন ধার্য করার অধিকারটিও তাই।
শ্রমবিধি তৈরির মাধ্যমে যে সংস্কার হল, তাতে নতুন চাকরি হয়তো তৈরি হবে, কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্ষীণ। তার কারণ হল, এই শ্রমবিধিতে দর-কষাকষির পাল্লা মালিকপক্ষের দিকে ভারী। তার চেয়েও বড় কথা, গোটা দেশের অর্থনীতি যখন কোভিড-১৯’এর আক্রমণে বিধ্বস্ত, তখনই এই সংস্কারটি হল— সংসদীয় আলোচনাকে কার্যত পাশ কাটিয়ে। সামাজিক পরিসরেও যথেষ্ট আলোচনা হল না। প্রশ্ন হল, যে আশায় এই সংস্কার করা হল, তা কি পূর্ণ হবে? দেশে শিল্প-বিনিয়োগের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হবে? নতুন লগ্নির হাত ধরে কি নতুন কর্মসংস্থান হবে? এই সময়ে এই সব প্রশ্নের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই।
ভূতপূর্ব উপদেষ্টা, কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy