কথক পাল্টালে গল্পও খানিক পাল্টে যায়, এ কথা স্বয়ং দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারই স্বীকার করেছিলেন। ঠাকুরমার ঝুলি এবং ঠাকুরদাদার ঝুলি-তে তাঁর বলা গল্প থেকে দশটি বেছে খানিক পাল্টে নতুন করে বলেছেন শতাব্দী। এই নতুন রূপকথায় রাজকন্যেরা আর ‘ড্যামসেল ইন ডিস্ট্রেস’ নয়, তারা নিজেরাই দিব্য নিজেদের জীবনের রাশ ধরতে পারে। সোনার কাঠি রুপার কাঠির ঘুমন্ত রাজকন্যা যেমন রাজপুত্রের রানি হওয়ার বদলে বেছে নেয় স্বাধীন জীবন। আবার, শেয়াল পণ্ডিতের গল্পে আসল আখ্যানের অকিঞ্চিৎকর কনেটিই এক কোপে নামিয়ে দেয় শেয়ালের মুন্ডু। মজা হল, লিঙ্গের প্রশ্নটাকে ঘুরিয়ে দেখলেই পাল্টে যায় হিংস্রতার গল্পও। লালকমল নীলকমল যেমন শেষ অবধি বোঝে, যাদের তারা রাক্ষসী ভাবছিল, তারা একটু অন্য রকম মানুষমাত্র— মেয়েদের বেশি খিদে পায় বলেই তাদের মেরে ফেলা যায় না। আগে বহু বার বলা গল্পের এই বিনির্মাণ বিশ্বসাহিত্যে খুব অপরিচিত ঘটনা নয়, তবে বাংলায় এমন কাজ আগে হয়েছে কি?
রানি-কন্যে কথা
শতাব্দী দাশ
৫৯৯.০০
জিলিপি

নামে ‘দস্যি মেয়ে’ থাকলেও এ বইয়ের অনেকগুলো রূপকথাই কিন্তু ‘ভাল মেয়ে’দের। তবে হ্যাঁ, একের ও দশের সুকাজ করতে গিয়ে তারা নানা চ্যালেঞ্জ নেয়, ‘দস্যি’ শব্দটা হয়তো সেই দিকে ইঙ্গিত করছে। এই সবই অনুমান, কারণ সম্পাদিত বই হলেও এতে সম্পাদকদের তরফে একটিও কথা নেই। যে বই উৎসর্গ অভয়াকে, যার সূচিপত্রে অগ্রজ-অনুজদের ভাগ করা হয়েছে পূর্বমাতৃকা আর উত্তরকন্যা বলে, তার পশ্চাৎভাবনাটি পাঠক জানতে পারলেন কই! গল্পগুলি মিষ্টি, রূপকথার সরল নিটোল ছন্দ তাদের সর্বাঙ্গে। এসেছে ‘রোল রিভার্সাল’-এর ধারণা, আধুনিক সময়, পরিবেশ, এমনকি বিজ্ঞানেরও ছোঁয়া। দিবাকর চন্দের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ, ভাল ছাপার গুণে ছোটরা হাতে তুলে নেবেই।
দস্যি মেয়ের রূপকথা
সম্পা: যশোধরা রায়চৌধুরী রোহিণী ধর্মপাল, যূথিকা আচার্য
৫৯৯.০০
হযবরল

আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে বেরিয়েছিল পূর্ণেন্দু পত্রীর এই তিনটি বই, বাঙালির বিলক্ষণ প্রিয়। রাম রাবণের ছড়া ফিরত সেই সময়ের ছোটবড় সবার মুখে, যেমন রাবণের মুখে বসানো এই অংশটি— “মারীচ মারীচ ডাক ছাড়ি/ মারীচ গেছে কার বাড়ি? মারীচ যাগে-যজ্ঞে/ ব্যস্ত আছে? হোক গে...” যেমন ছড়া, তেমনই চোখ ভরে দেখার খোদ কবি-শিল্পী সহ যুধাজিৎ সেনগুপ্ত ও সুব্রত চৌধুরীর আঁকা ছবিগুলি। ক্লাস সেভেনে পড়া, অঙ্কে কাঁচা দুষ্টুর ছড়া লেখা; “রামের ছেলে লব ও কুশ/কোথায় পাবে লবেনচুষ?” হয়ে ক্রমে গোটা রামায়ণকেই ছড়া দিয়ে ছুঁতে চাওয়ার সরস কাহিনি ধরা আছে দুষ্টুর রামায়ণ-এ। আর সুকুমার রায়ের জন্মশতবর্ষে লেখা নাটক বাবুরাম সাপুড়ে-তে ঘোরাফেরা করে সুকুমার-বিশ্বের চরিত্ররা। নতুন করে ছাপা বইগুলি এই প্রজন্মের শিশুরা না পড়লে বুঝবে না, বাংলা শিশুসাহিত্য ও তার ভাষাটি কেমন রসের সাগর।
রাম রাবণের ছড়া, দুষ্টুর রামায়ণ, বাবুরাম সাপুড়ে
পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রতিটি ১৫০.০০
প্রতিক্ষণ

দেশভাগের পটভূমিকায় শান্তি লাহিড়ীর নিজ অভিজ্ঞতাপ্রসূত কিশোর উপন্যাসটি আশির দশকে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। কাহিনি কিছুটা আম আঁটির ভেঁপু-র উত্তরসূরি, ভাগ্যচক্রে এসে পড়ে সাদাত হোসেন মান্টোর তীক্ষ্ণ জীবনদৃষ্টি। কেন্দ্রীয় চরিত্র সুমনের চোখে অপুর মায়া, অবিভক্ত বাংলাদেশের পল্লিগ্রামটিতে নিশ্চিন্দিপুরের ছায়া। কিশোরের চার দিকে জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ভিড় করে, মমতাময়ীদের আঁচল যাদের ঠেকানোর চেষ্টা করে আপ্রাণ। কিন্তু ক্রমে সব অঙ্ক তছনছ করে দেশভাগের কাঁটাতার। দীর্ঘ দিন পর, স্বদেশ ও প্রতিবেশী দেশের এক অস্থির সময়ে এই বইটির পুনর্মুদ্রণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে, এমন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকীর্তি পুনঃপ্রকাশের সময়ে বানান নিয়ে সতর্কতা কাম্য।
আংলা বাংলা
শান্তি লাহিড়ী
২০০.০০
পারুল প্রকাশনী

প্রতিটি খোকাখুকুই তার কল্পরাজ্যের রাজা-রানি। এই নিষ্পাপ জগতের আশ্চর্য কাণ্ডকারখানা নিয়ে বহু শিশুসাহিত্য রচিত হয়েছে ও হচ্ছে। তালিকায় নতুন সংযোজন এই বই, একটি ওয়েবজ়িনে বারো পর্বে প্রকাশিত গল্পগুলি একত্রিত হয়েছে রঙিন ও প্রাণবন্ত দু’মলাটে। লেখক ছবি-আঁকিয়ে, তাই তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার মাধ্যমে চরিত্রগুলির চোখের সামনে আকর্ষণীয় ভাবে ফুটে ওঠে। কাহিনিগুলির প্রেক্ষাপট পুরনো কলকাতা হলেও শব্দচয়ন কথনভঙ্গি একেলে, আধুনিক। ঘোর পারিবারিক সঙ্কটও উপস্থাপিত হয়েছে মজার মোড়কে। কৌতুকচাঞ্চল্য নয়, এই সুনীল হৃদয়বৃত্তিই বইটির প্রাণ।
মহারাজ ছনেন্দ্রনাথের রোমাঞ্চকর গল্পসমূহ
রমিত চট্টোপাধ্যায়
২৭৭.০০
গুরুচণ্ডা৯

উপেন্দ্রকিশোরের অগ্রজ মুক্তিদারঞ্জন রায়ের একটি রচনা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে এ-বইয়ের বিষয়বস্তুকে, জানিয়েছেন লেখক, পরিশিষ্টে যোগ করেছেন রচনাটি। পরিশিষ্টে তাঁর আরও একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন: রায় পরিবারের সদস্যদের গ্রন্থপঞ্জি। ছোটদের নিয়ে তাঁরা ভাবতেন, তাদের জন্যে লিখতেন, ছবি আঁকতেন, পত্রিকা প্রকাশ করতেন... রায় পরিবারের সাহিত্য সেই উনিশ শতকের শেষ থেকে শিশু-কিশোরদের কী ভাবে প্রাণময় করে রাখত, বাংলা সাহিত্যে হয়ে উঠেছিল অবিসংবাদিত, তারই প্রয়োজনীয় রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছেন লেখক। অবশ্যপাঠ্য।
সত্যজিৎ ও রায় পরিবারের শিশুসাহিত্যচর্চা
পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
৩৯৫.০০
পুনশ্চ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)