Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
National news

ভারতে জাতির এই আত্মপরিচয় কি একান্ত কাম্য?

জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তা হলে আরএসএস নেতা কী করছেন? প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ঘোষাল আমি হিন্দু। তার মানে আমি মুসলমান নই। আমি বৌদ্ধ নই। জৈন নই। আমি ঠিক। তুমি বেঠিক। ১৫ অগস্ট ১৯৪৭ ঠিক। তোমার ১৯৪৭-এর ১৪ অগস্ট হল বেঠিক?

বাচুমারাক। —ফাইল চিত্র।

বাচুমারাক। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৭ ০০:০৬
Share: Save:

আত্মপরিচয়ের জন্য কি সব সময়েই একটা বিপরীত নির্মাণ প্রয়োজন? অন্য কিছুর বিপরীতেই কি আমরা সব সময় নিজেকে খুঁজি? আমি হিন্দু। তার মানে আমি মুসলমান নই। আমি বৌদ্ধ নই। জৈন নই। আমি ঠিক। তুমি বেঠিক। ১৫ অগস্ট ১৯৪৭ ঠিক। তোমার ১৯৪৭-এর ১৪ অগস্ট হল বেঠিক?

টিভির পর্দায় দেখছি, দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আরএসএস-এর প্রবীণ নেতা ইন্দ্রেশ কুমার বলছেন, মাংস হল অসুখ। দুধ হল পুষ্টি। সুস্বাস্থ্য। ইসলামের দোহাই দিয়ে আরএসএস নেতা বলছেন, এই সব তথ্য ইসলামেই আছে। মুসলমান সমাজকে এ সব কথা মানতে পরামর্শ দিয়েছেন। সমস্যা হচ্ছে মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে এ হেন সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব কেন? এই খবরটির পাশাপাশি আর একটি খবর দেখছি। মেঘালয়ে বিজেপি-র তুরা জেলা নেতা বাচুমারাক গরু খাদ্যাভ্যাস নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে দল থেকেই ইস্তফা দিলেন। গারো হিল‌স‌্ এলাকায় গরু খাওয়া দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। বাচুমারাক ওই এলাকায় মোদী সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে গোমাংস ভক্ষণের উত্সব চালু করেন। কিন্তু বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ উত্সবে মানা করেন। তুরা জেলা সভাপতি বাচুমারাক এ নির্দেশ মানতে রাজি হননি। বাচুমারাক বলছেন, দীর্ঘ দিন ধরে আমরা গরুর মাংস খাই। এলাকার মানুষের এই খাদ্যাভ্যাসকে আমাদের মর্যাদা দেওয়া উচিত। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, যে সব হিন্দু অন্য মাংস খাচ্ছেন তাঁদের বাধা দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের ক্ষেত্রে কেন হবে? ঘটনাচক্রে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এই জনসংখ্যায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।


জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বিক্ষোভ

আবার একই সঙ্গে অন্য একটি খবর, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আরএসএস নেতা ইন্দ্রেশ কুমার বলছেন, প্রফেট মহম্মদ নিজে মাংস খেতেন না। দুধ খেতেন। এই ঘটনায় জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বিক্ষোভ শুরু হয়ে গিয়েছে।

জাতির এই আত্মপরিচয় কি একান্ত কাম্য ভারত নামক এই দেশটার জন্য?

ভারত কেবলমাত্র বৈদিক-আর্য ধর্মাবলম্বীদের দেশ নয়। ভারত পুরাণ, স্মৃতি কল্পিত জম্বুদ্বীপের চতুর্বর্ণাশ্রমীয় রাষ্ট্র নয়। ভারতে হিন্দু যেমন আছে, তেমনই তাঁদের মধ্যেও নানা ভাগ আছে। এর সঙ্গে বেদ-পুরাণের কোনও সম্পর্ক নেই। ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘ভারতীয় সমাজ পদ্ধতি’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে ভারত ও ইসলাম সম্পর্কে খুঁজতে গিয়ে বলেছেন, “ভারতের সহিত ইসলাম-পূর্ব্ব আরবের সম্পর্কের পরিচায়ক তিনখানি প্রস্তর-ফলক পশ্চিম ভারতের ‘ভুজ’ (Bhuj) নামক জায়গায় গোরস্থানে আবিষ্কৃত হইয়াছে। একখানি হিব্রুভাষায় লিখিত জনৈক ইহুদীর কবরের মধ্যে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে।... অপর দুইখানি দক্ষিণ-আরবের হিমইয়ারীয় (Himyaritic) ভাষায় এবং অক্ষরে লিখিত। এইগুলি আরবের সাবাইয় (Sabaean) প্রস্তরলিপির অন্তর্গত। আরবের সভ্যতা সর্ব্ব-প্রথম সাবাইয়-যুগে দক্ষিণে বিবর্ত্তিত হয় (Hitti: History of the Arabs, pp. 30-66)। বোম্বাই মিউজিয়ামে এই ধরণের আর একখানি প্রস্তরলিপি রক্ষিত আছে। এই লিপি একটি নরমূর্ত্তির গাত্রে খোদিত হইয়াছে; মূর্তিটির মস্তকে একটি টুপি এবং কোমর হইতে জানু পর্য্যন্ত loin-cloth দ্বারা আচ্ছাদিত; আর বাকী সব অংশ অনাচ্ছাদিত। এই মূর্তিটি ‘waddab’ নামক এক দেবতার মূর্তি বলিয়া অনুমিত হয়। হিটি বলেন, দক্ষিণ আরবদের চন্দ্র দেবতার নাম ছিল Wadd (পৃঃ ৬০)। এতদ্বারা নির্দ্দারিত হয় যে, অতি প্রাচীন কাল হইতে আরবেরা কার্য্যোপলক্ষে ভারতে আগমন করিতেন। ব্যবসায় নিশ্চয়ই এই কার্য্যের উপলক্ষ ছিল। এই বিষয়ে Epigraphia Indica, Vol, XIX; 1927-28, No. 54; ‘Three Semitic Inscriptions from Bhuj, pp. 300-330.’’

ভূপেনবাবুর লেখা থেকে পড়ছিলাম, আবুল ফজলের আকবর-নামা পুস্তকে ইসলামীয় প্রবাদ আছে। বাবা আদম স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে, মর্ত্যে সারন-দ্বীপে (সুবর্ণদ্বীপ) অবতরণপূর্বক বাসস্থল নির্মাণ করেন (আমীর খসরুর ফার্শী কবিতা আছে)। এ জন্য সিংহলের আদমপিক মুসলমান সমাজের তীর্থস্থল তথ্য ভারাক্রান্ত করব না শুধু এটুকু বলতে পারি ভারতের সঙ্গে আকবরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। দুই এলাকার মধ্যে সাংস্কৃতিক দেওয়া নেওয়া ছিল। মুসলমান সমাজের মধ্যেও খাদ্যাভ্যাস ও আচার আচরণে অনেক স্তর ছিল। আরএসএসের যুগ্মসচিব দত্তাত্রেয় হোসবলে এক সাক্ষাৎকারে (ওপেন,১২ জুন, ২০১৭) বলেছেন, হিন্দু শব্দটি যখন আমরা উচ্চারণ করি, ধর্মীয় অর্থে করি না। সাংস্কৃতিক অর্থে করি। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে কী দেখছি? হোসবলে বলেছেন, ১৯০২ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় একটি বই লেখেন ‘History of Hindu Chemistry’। বন্দে মাতরম কংগ্রেস সম্মেলনে প্রায় গাওয়া হত। গরুর সুরক্ষার জন্য কংগ্রেস অধিবেশনে প্রদর্শনের প্রস্তাব দেন গাঁধী। সভরকর বলেছিলেন মাংস খেলে কোনও সমস্যা নেই। গাঁধী নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস প্রচার করেন। দত্তাত্রেয় হোসবলের বক্তব্য, সভরকর হিন্দুত্ববাদী হলে গাঁধীজি নন? সন্ন্যাসী হয়েও স্বামী বিবেকানন্দ আমিষ বন্ধ করেননি। আরএসএস নিরামিষ ভক্ষণ প্রচার করে না।

জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তা হলে আরএসএস নেতা কী করছেন? কেন করছেন?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE