ভারতীয়রা কি সত্যই তর্কশীল? সামাজিক মাধ্যমে সাম্প্রতিক দুইটি ছবি ও তাহা লইয়া লাইক, শেয়ার, কমেন্টের ভাইরাল ঘূর্ণিবাত্যা ফের এই পুরাতন প্রশ্নটি সম্মুখে আনিতেছে। প্রথম ছবিটি ইসরো চেয়ারম্যান, মহাকাশবিজ্ঞানী কৈলাসাভাড়িভু শিবনের। দ্বিতীয়টি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্যসমাপ্ত ছাত্রভোটে সভাপতি পদে বিজয়ী বাম ছাত্রনেত্রী ঐশী ঘোষের। চন্দ্রপৃষ্ঠে চন্দ্রযান বিক্রমের সহিত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হইবার পরে মধ্যরাতে শিবনের অশ্রু, প্রধানমন্ত্রীর তাঁহাকে বক্ষে টানিয়া লওয়ার ছবি ইতিমধ্যেই বহুচর্চিত। অতঃপর যে ছবিটি সাইবার দুনিয়ায় উদিত হইল, তাহা চন্দ্রাভিযানের পূর্বে তিরুপতি মন্দিরে ইসরো চেয়ারম্যানের পূজা অর্পণের ছবি। এক দল নাগরিক তৎক্ষণাৎ রে-রে করিয়া উঠিলেন, মহাকাশবিজ্ঞানী কেন মন্দিরে দেবতার কৃপাপ্রার্থী হইবেন? কেহ কেহ বলিবার চেষ্টা করিলেন, ইহা ব্যতিক্রম নহে। প্রতিটি মহাকাশ অভিযানের আগে, তাহার সাফল্যকামনায় ভগবান তিরুপতির পদতলে রকেটের একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ অর্পিত হয়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ নাহি শোনে ঐতিহ্যের বাণী! ঐশীর ঘটনাও তদ্রূপ। বিপ্লবের অঙ্গীকারবদ্ধ তাঁহার মুষ্টিবদ্ধ হস্তে শোভা পাইতেছে একটি কবচ। সমালোচনার মুখে পড়িয়া কেহ সাফাই গাহিতেছেন, উহা পুরানো ছবি। কেহ বা বলিতেছেন, উহা মায়ের মঙ্গলাশিস। দিল্লি যাত্রার পূর্বে ঐশীর মাতা উহা কন্যার বাহুতে বাঁধিয়া দিয়াছিলেন।
অথচ কুতর্কের মুখে পড়িয়া ইসরোর বিজ্ঞানীকুল বা ঐশীর সমর্থকমহল, কাহারও এইরূপ দ্বিধাগ্রস্ত সাফাইদান না করিলেও চলিত। কম্পিউটারে কোষ্ঠীবিচারের এই দেশে তাঁহারা নিজ ইচ্ছায় এমন করিলে এই উত্তর-আধুনিকতার যুগে অবাক হইবারও কিছু নাই। মনোবিশ্লেষক সুধীর কক্কর একদা ভারতীয় মানস বিশ্লেষণকল্পে ‘নম্য হিন্দুত্ব’ নামক শব্দবন্ধ ব্যবহার করিয়াছিলেন। এ দেশের বিজ্ঞানীরা কেন অনেকে গ্রহশান্তির আংটি ধারণ করেন সেই প্রসঙ্গেই ওই শব্দটির আমদানি। মনোবিজ্ঞানী জানাইয়াছিলেন, ইহা ভণ্ডামি নহে। ইহা হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য। এই ধর্ম মুখ্যত পরিস্থিতিভিত্তিক। তাই সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরও ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ’ বলিতে পারেন, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখাইয়া বলেন, আত্মীয়বধের জন্য শোকসন্তাপ করিয়ো না। আমি ইহাদের পূর্বেই মারিয়া রাখিয়াছি। যুদ্ধের বহু পরে, তিনি নিজেই এক ব্যাধের শরে মৃত্যুবরণ করেন। নম্য হিন্দুত্ব আছে বলিয়া আমরা সকালে উপবাস করিয়া অষ্টমীর অঞ্জলি দিই, অতঃপর সেই সন্ধ্যায় মণ্ডপে ফের এগরোল, ফুচকা গলাধঃকরণ করি। অতএব, পরিস্থিতি-সাপেক্ষে কোনও মহাকাশবিজ্ঞানী সকালে তিরুপতি মন্দিরে যাইতে পারেন, সন্ধ্যায় রকেটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করিতে পারেন। কোনও তরুণী হাতে তাবিজ, কবচ ধারণ করিয়াও ছাত্র ইউনিয়নে বিপ্লবের নামে ভোট চাহিতে পারেন। হিন্দু ধর্ম বলিয়া যে সব আদর্শ এই দেশে প্রচলিত, তাহাদের অনেকের মতেই, এই দুইয়ে কোনও বিরোধ নাই। স্থানিক দেশাচার ও সময়ের কালাচার সে অাদর্শে স্বীকৃত। প্রগতিশীলতার বাসরঘরে যে হেতু কালনাগিনীর ছিদ্র, রক্ষণশীল উগ্র ধর্মশীলরা যেমন ধর্মের একটিই বয়ান মানেন, প্রগতিশীলরাও তদ্রূপ। তাঁহারা দেশাচার, লোকাচার, কালাচারের কথা ভাবেন না। তাঁহাদের কাছে ধর্মের যে কোনও চিহ্নই সংস্কারের আফিম। অথচ যাঁহার নামে প্রগতিশীলতার এই আফিম-সংস্কার চলিতেছে, সেই কার্ল মার্ক্স এক নিঃশ্বাসে ধর্ম সম্বন্ধে আরও কিছু বলিয়াছিলেন। ধর্ম অত্যাচারিতের দীর্ঘশ্বাস এবং হৃদয়হীন পৃথিবীর হৃদয়। তাবিজ এবং পূজা লইয়া কূট প্রশ্ন তোলাই যায়, কিন্তু তুলিতে গিয়া এই দেশাচারের বিষয়টি ভুলিয়া গেলে চলিবে না।
দেশাচার বস্তুটি সামান্য যে নহে, তাহা যে দেশাত্মবোধের সহিত জটিল ভাবে জড়িত থাকে, ইহা নূতন কথা নহে। সেই কারণেই জাতীয়তাবাদের আদর্শ ও প্রয়োগে ধর্মাচার, এবং তাহার পথ ধরিয়া ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার প্রবেশ ঘটিয়া থাকে। কিন্তু ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা আটকাইতে গিয়া ধর্ম ও আচারকেই আক্রমণ করিলে মুশকিল, ঠিক যেমন জল নোংরা বলিয়া জলসুদ্ধ শিশুটিকেই বালতি হইতে ফেলিয়া দেওয়া অন্যায়। সুতরাং কেন কেহ আপন ঘরে আচার পালন করিতেছেন, এই প্রশ্ন থাকুক। বরং কেন কেহ অন্যের ঘরে ঢুকিয়া অন্যের আচার পালন (এবং খাদ্য চয়নে) বাধা দিতেছেন, তর্কশীলের প্রশ্ন হওয়া উচিত তাহাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy