মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপিতে নরেন্দ্র মোদীর উত্তরসূরি হওয়ার অন্যতম দাবিদার দেবেন্দ্র ফডণবীস যখন আচমকাই তাঁর রাজ্যে ঔরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবি তুললেন, তখন প্রশ্ন উঠেছিল, এত ভোটে জিতে তাঁর হঠাৎ চারশো বছরের পুরনো কবর নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়ল কেন? অভিযোগ উঠেছিল, আসলে মহারাষ্ট্রের ভোটে জিততে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি। এখন ক্ষমতায় এসে বিজেপি টের পেয়েছে, রাজকোষ ফাঁকা। দেনা বাড়ছে। আমজনতার হাতে নগদ টাকা উপহার দেওয়া কঠিন। তাই সেখান থেকে নজর ঘোরাতে আচমকাই ঔরঙ্গজেবের কবর নিয়ে টানাটানি।
নরেন্দ্র মোদীর সরকার বেছে বেছে ঠিক ২ এপ্রিলই সংসদে ওয়াকফ বিল নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। ঠিক যে দিন ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের উপরে পাল্টা চড়া শুল্ক বসানোর হুমকি দিয়েছিলেন। এমনিতেই মোদী জমানায় অর্থনীতির হালহকিকত নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। গৃহস্থের দেনা বাড়ছে। দেশের আয়ে মধ্যবিত্তদের ভাগ ব্রিটিশ আমলের স্তরে পৌঁছে গিয়েছে। বেকারত্বের প্রশ্ন তো রয়েছে। তার উপরে ট্রাম্পের শুল্ক চাপলে পোশাক, গয়না-অলঙ্কারের মতো ক্ষেত্রে ধাক্কা লাগবে। এ সব পণ্য শুধু বিপুল পরিমাণে আমেরিকায় যায় বলে নয়, এই সব শিল্পে বহু মানুষের রুটিরুজি চলে।
অর্থনীতিতে এই অনিশ্চয়তা থেকে নজর ঘোরাতেই কি বেছে বেছে ২ এপ্রিল থেকে মোদী সরকার সংসদে ওয়াকফ বিল নিয়ে আলোচনা শুরু করল? বিরোধী শিবির থেকে প্রশ্নটা উঠেছে।
ওয়াকফ বিল অবশ্য আসারই ছিল। গত দশ বছরে এক দিকে বিজেপি-আরএসএস দেশের মুসলিমদের নানা ভাবে ‘ভিলেন’ সাজিয়ে তাদের কাঠগড়ায় তুলেছে এবং সামাজিক ভাবে কোণঠাসা করেছে। অন্য দিকে, মুসলিম সমাজের নানা অনিয়ম, দোষ-ত্রুটি দূর করে সংস্কারের ‘দায়িত্ব’ও নিজেরা চালিয়েছে। এক দিকে গেরুয়া শিবির মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘লাভ জেহাদ’ থেকে ‘ল্যান্ড জেহাদ’ অভিযোগ তুলেছে। দেশে কোভিড ছড়ানোর জন্যও মুসলিমদের দায়ী করেছে। অন্য দিকে, তিন তালাক নিষিদ্ধ করে তাকে ফৌজদারি অপরাধের তকমা দিয়ে দাবি করেছে, মুসলিম মহিলাদের উপকার করতেই এই আইন।
ওয়াকফ বিল একই সঙ্গে এই দুই লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার। এক দিকে, হিন্দুত্ববাদীরা প্রচার করছেন, ওয়াকফ বোর্ডের হাতে যে পরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে, তা এ দেশে রেল ও সেনাবাহিনী ছাড়া আর কারও নেই। কথাটা শুনলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। তার পরে যদি বলা যায়, ওয়াকফ বোর্ডের হাতে ৯.৪ লক্ষ একর জমি রয়েছে, তা হলে ফের মুসলিমদের সম্পর্কে দেশের সম্পত্তি দখল করার সন্দেহটা উস্কে দেওয়া যায়। বাস্তব হল, দেশের যে কোনও কবরখানা, মসজিদও ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি। এমন নয় সেই সম্পত্তি মুসলিমরা ভোগ করছে।
আর জমির পরিমাণ নিয়ে ভাবলে বলতে হয়, শুধু তামিলনাড়ু, অন্ধ্র ও তেলঙ্গানাতেই হিন্দু ধর্মীয় সংস্থাগুলির হাতে ১০ লক্ষ একরের বেশি জমি রয়েছে। বাকি উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের হিসেব ধরলে এই সংখ্যাটা কোথায় পৌঁছবে, তা অনুমান করাও কঠিন। অন্য দিকে, ওয়াকফ বোর্ডের সংস্কার করে সরকার যে আসলে সাধারণ গরিব মুসলিমদের উপকার করতে চাইছে, এই প্রচারও চলছে।
দেশ জুড়ে ওয়াকফ বোর্ডের বিপুল সম্পত্তি কোনও দিনই গরিব, অনগ্রসর মুসলিমদের উপকারে আসেনি। ওয়াকফের সম্পত্তি পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব রয়েছে। দুর্নীতিও রয়েছে। সাচার কমিটি প্রায় দু’দশক আগে, ২০০৬ সালে তার রিপোর্টে ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি ঠিকমতো কাজে লাগানো হচ্ছে না বলা অভিযোগ তুলেছিল। একই সঙ্গে শিক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলিমরা কী ভাবে পিছিয়ে রয়েছে, তা-ও বলেছিল সাচার কমিটি। সাচার কমিটির বক্তব্য ছিল, ওয়াকফের সম্পত্তি কাজে লাগিয়ে যদি অন্তত ১০ শতাংশ আয় ঘরে তোলা যায়, তা হলে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা আয় হতে পারে। সেই অর্থ মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগে।
মুশকিল হল, গত ৭৫ বছরে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক, সংখ্যালঘু তোষণ নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। কিন্তু মুসলিমদের মধ্যে কেন ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ নিরক্ষর, কেন মুসলিমরা শিক্ষার মাপকাঠিতে দলিতদের থেকেও পিছিয়ে, উচ্চশিক্ষায় মুসলিমদের কেন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হয়, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক হয়নি। তার বদলে তিন তালাক থেকে ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি, মসজিদের তলায় মন্দির থেকে লাভ জেহাদ নিয়েই আলোচনা অব্যাহত।
এ বার মোদী সরকার ওয়াকফ বিল নিয়ে সক্রিয় হতে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড থেকে ওয়াকফ বোর্ডের নেতারা বিরোধিতা শুরু করেছেন। মুশকিল হল, বজরং দল বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ যেমন হিন্দু সমাজের স্বঘোষিত নেতা, ঠিক তেমন এই মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড বা ওয়াকফ বোর্ডের হোতারা আদৌ মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রয়োজনমতো এঁরা রাজনীতিকদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেন। কিন্তু গোটা মুসলিম সমাজকে ধর্মের নামে আধুনিক শিক্ষা থেকে দূরে রাখার কাজ চালিয়ে যান। তাতে গেরুয়া শিবিরই মুসলিমদের উপকারের নামে মুসলিমদের ধর্মীয় বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ পেয়ে যায়। যেমন, এখন ওয়াকফ বিলে কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ডে অ-মুসলিমদের নিয়োগ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মোদী সরকার কি কখনও আইন করে হিন্দু ধর্মীয় সংস্থার পরিচালন পরিষদে অ-হিন্দুদের বসানোর ব্যবস্থা করতে পারবে?
গেরুয়া শিবিরের বার্তা স্পষ্ট। মুসলিমদের কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ, কোন মুসলিম ভাল, কোন মুসলিম খারাপ, তা তাঁরাই ঠিক করে দেবেন। কারা মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবেন, তা-ও গেরুয়া শিবিরই ঠিক করে দিতে চেয়েছে। তাই লোকসভা নির্বাচন হোক, বা উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন, বিজেপি কোনও মুসলিমকে প্রার্থী করে না। কিন্তু যোগী সরকার বিধান পরিষদে পছন্দের মুসলিম নেতাকে জিতিয়ে এনে মন্ত্রী করে। মোদী সরকার লোকসভায় কোনও মুসলিম বিজেপি নেতাকে জিতিয়ে না আনলেও আগে মুখতার আব্বাস নকভির মতো রাজ্যসভায় জিতে আসা নেতাকে মন্ত্রী করেছে। কিন্তু এখন সেই মুসলিম প্রতিনিধিত্বটুকুও রাখতে নারাজ। ২০২৪-এ দেশের ইতিহাসে প্রথম বার এমন মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছে, যেখানে কোনও মুসলিম মন্ত্রী নেই। শুধু মন্ত্রিসভা নয়, বিজেপি তথা এনডিএ শিবিরে এখন কোনও মুসলিম সাংসদ নেই। আগে বিজেপির রাজ্যসভায় মুসলিম সাংসদ ছিলেন। এখন তা-ও নেই। অথচ মুসলিম-বর্জিত মোদী সরকার তথা বিজেপিই মুসলিমদের উন্নয়নের দোহাই দিয়ে ওয়াকফ বোর্ডের সংস্কারে বদ্ধপরিকর। তাঁরাই ঠিক করে দিতে চান, কে ভাল মুসলিম, কে খারাপ মুসলিম।
আরএসএস-এর সরকার্যবাহ বা সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসবলে সম্প্রতি রায় দিয়েছেন, ঔরঙ্গজেব খারাপ, দারাশুকো ভাল। মুসলিমদের ঔরঙ্গজেবের পথে নয়, দারাশুকোর পথে হাঁটতে হবে। কিন্তু দারাশুকো যে হিন্দু, মুসলিম সৌভ্রাত্রের কথা বলতেন, সে পথে সঙ্ঘ পরিবার নিজে হাঁটে না কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর মেলে না। এত দিন সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বলছিলেন, রামমন্দিরের পরে আর মসজিদ ভেঙে মন্দিরের দাবিতে আন্দোলন করার প্রয়োজন নেই। আরএসএস আর কোনও মন্দির-মসজিদ আন্দোলনে জড়াবে না। সব মসজিদের নীচে মন্দির খুঁজতে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। এখন সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, সমর্থকরা কাশী-মথুরাতেও মসজিদ ভেঙে মন্দিরের দাবি তুললে তিনি বাধা দেবেন না। মনে হচ্ছে, আবার সেই ‘অযোধ্যা তো ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’ মন্ত্রে ফেরা হচ্ছে।
মন্দির-মসজিদ থেকে ওয়াকফ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে বিতর্ক জিইয়ে রাখার সুবিধাটা হল, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, আমজনতার সংসারের রোজকার সমস্যা, রুটিরুজির চিন্তা থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে রাখা যায়। মজার কথা হল, ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল, তাঁর আমলে যে কৃষি থেকে নানা ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দিয়েছিল, তা থেকে নজর ঘোরাতেই ধর্মান্ধতার পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাই চারশো বছর পরেও তাঁর সমাধি ভাঙার দাবি ওঠে। ইতিহাসের এই ইতিকথা সব শাসকেরই মনে রাখা উচিত।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)