Advertisement
E-Paper

জলবায়ুর কারণে ঘরছাড়া

পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম— চারটি গোলার্ধকেই ছুঁয়ে থাকা কিরিবাটির অধিবাসীদের জলমগ্ন হওয়ার আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে সমুদ্রতলের স্ফীতির কারণে।

শুভঙ্কর ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:২৩
Share
Save

মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের ছবির মতো দ্বীপরাষ্ট্র কিরিবাটির বাসিন্দা আয়ন টেইটিওটা নিউ জ়িল্যান্ডে জলবায়ু-শরণার্থী হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম— চারটি গোলার্ধকেই ছুঁয়ে থাকা কিরিবাটির অধিবাসীদের জলমগ্ন হওয়ার আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে সমুদ্রতলের স্ফীতির কারণে। ২০১৫ সালে টেইটিওটার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে, রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিটির কাছে তিনি নিউ জ়িল্যান্ড সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। ২০২০ সালে রায় ঘোষিত হলে টেইটিওটার অভিযোগ মান্যতা পায়, কিন্তু নিউ জ়িল্যান্ডের নাগরিকত্ব তাঁর অধরাই থাকে।

আয়ন টেইটিওটা অবশ্য একা নন। গবেষণা বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে গোটা দুনিয়ায় ক্লাইমেট রিফিউজি বা জলবায়ু-উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়াবে ১২০ কোটি। দুনিয়ার মোট জনসংখ্যার আট ভাগের এক ভাগ। ঋত্বিক ঘটকের কোমল গান্ধার ছবিতে বৃদ্ধের আকুতি ছিল: “ক্যান যামু? বোঝা আমারে, এমন কোমল দেশডা ছাইড়া আমার পদ্মারে ছাইড়া যামু ক্যান?” সেই প্রশ্নের কঠিন উত্তর আসে “যাইবা খাইবার লইগা। এই শেষ সুযোগ, এখন শরণার্থী হও।” অর্থাৎ, এখন থেকে তুমি উদ্বাস্তু। মুহূর্তে পাল্টে যায় আত্মপরিচয়, ইতিহাসের আবহমান উদ্বাস্তু তালিকায় যোগ হয় আর একটি নাম। যুদ্ধ, শ্রেণি সংঘর্ষ, দুর্ভিক্ষ, বন্যা-সহ নানা কারণে ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের কথা ধরা আছে দেশ-বিদেশের বহু সিনেমায়, নাটকে, উপন্যাসে। জলবায়ুও যে মানুষকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করতে পারে, সে কথা অবশ্য দুনিয়া জেনেছে— বলা ভাল, স্বীকার করেছে— বহু পরে।

২০১৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের শাখা সংস্থা ইউনাইটেট নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচসিআর) যে তথ্য দিয়েছিল, তাতে দেখা যায়, প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয়প্রার্থী। এই পরিযাণের মূল কারণ হিংসা, গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক অত্যাচার। মূলত পাঁচটি দেশ থেকেই এসেছেন উদ্বাস্তুদের দুই-তৃতীয়াংশ: সিরিয়া, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান, মায়ানমার ও সোমালিয়া। দেশের মধ্যে থেকেও প্রায় চার কোটির উপর মানুষ গৃহহীন। অন্য দিকে, পৃথিবী জুড়ে আজ প্রায় ২ কোটি ১৫ লক্ষ মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুহারা। ইউএনএইচসিআর উদ্বাস্তু সমস্যার সম্ভাব্য কারণ হিসাবে জলবায়ুকে স্বীকার করলেও, শরণার্থী হওয়ার শর্ত হিসাবে নিপীড়নজনিত পাঁচটি শর্তের— জাতি, ধর্ম, নাগরিকত্ব, গোষ্ঠী সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক— বাইরে আইন প্রণয়ন করে উঠতে পারেনি আজও। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন ২০২৪-২০৩০’এর জন্য যে রূপরেখা তৈরি হয়েছে, সেখানে আছে চারটি মূল বিষয়— পরিযায়ী বা স্থানান্তরিত মানুষকে সহায়তা দেওয়া; পরিচ্ছন্ন জীবনের সুযোগ; জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধক ব্যবস্থা; ও গ্রিন হাউস গ্যাস কমাতে উদ্যোগ।

রাষ্ট্রপুঞ্জ ১৯৫১-য় উদ্বাস্তু আইন কিংবা ১৯৬৭-তে উদ্বাস্তু প্রোটোকল তৈরি করলেও জলবায়ু-শরণার্থীদের জন্য পৃথক ভাবে আইনি রক্ষাকবচ এখনও বাস্তবায়িত করতে পারেনি। ভারতীয় সংবিধানেও জলবায়ু-উদ্বাস্তু নিয়ে কোনও প্রত্যক্ষ ধারা যোগ হয়নি। যদিও ১৯৭২ সালের স্টকহোম সম্মেলনের পর পরই গৃহীত হয়েছে সংবিধানের ৫১এ এবং ৪৮এ ধারা দু’টি। এগুলিতে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র— রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদে আর্টিকল ৩৫ অনুসারে, উদ্বাস্তু সামলানোর যাবতীয় দায় বর্তায় ইউএনএইচসিআর-এর উপরে, যাতে নাকি পরোক্ষ ভাবে যে কোন দেশের সার্বভৌমত্ব হারাবার আশঙ্কা থেকে যায়। সুতরাং, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল আন্তর্জাতিক স্তরে জলবায়ু-শরণার্থীদের যথাযথ সুরক্ষা-ব্যবস্থা এখনও গৃহীত নয়।

শক্তির উৎপাদন ও ব্যবহার এবং জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ সভ্যতার বর্তমান মানক, একটি অভিন্ন চালিকাশক্তি। সে জন্য শক্তির ব্যবহারে বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়ানোও এই মুহূর্তে কঠিন চ্যালেঞ্জ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সূর্যও এক দিন চিরতরে নিবে যাবে, থাকবে না পৃথিবীতে প্রাণ ধারণের মূল চাবিকাঠি এই সৌরশক্তিও। তবুও মানুষের লড়াই চলেছে বিকল্পের সন্ধানে। এক সময় জ্যোতিষে বিশ্বাসীদের আশঙ্কা ছিল, ২০২১ সালে পৃথিবীতে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ, উল্কাঘাতে সর্বনাশ ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রবল সম্ভাবনা। এই নিয়ে ষোড়শ শতাব্দীর ফরাসি জ্যোতিষী নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যদ্বাণী আজও সত্যি হয়নি। লড়াই চলবে শুধু শক্তি নিয়ে নয়, অন্ধ বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তিনিষ্ঠ বিজ্ঞানের।

২০২১ সালে পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কারের একটা অংশ যৌথ ভাবে পেয়েছেন জাপানের মানাবে এবং জার্মানির হাসেলমান— বিশ্ব উষ্ণায়নের সঠিক পরিমাপের পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য। অর্থাৎ, শুধুমাত্র বিশ্ব জুড়ে সচেতনতা বৃদ্ধি নয়, সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করাই হবে একমাত্র পথ। সে জন্য হয়তো পৃথিবীর তৃতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ নাউরু-র সিদ্ধান্ত, এক লক্ষ ডলারের বিনিময়ে নাগরিকত্ব বিক্রয় করে উপার্জিত অর্থ জলবায়ু বিপর্যয় রোধের কাজে ব্যয় করা।

পদার্থবিদ্যা বিভাগ, সেন্ট জ়েভিয়ার’স কলেজ, কলকাতা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

UNHCR Climate

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}