বি আর অম্বেডকর। ফাইল চিত্র।
দলিত শব্দটি এখন খুবই জনপ্রিয় এক রাজনৈতিক শব্দ। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অ্যান্টিথিসিস হয়ে গোটা দেশে দলিত আন্দোলন মাথা চাড়া দিচ্ছে। কাঁসিরাম-মায়বতীর নেতৃত্বের পর এক নবীন প্রজন্মও মাথাচাড়া দিচ্ছে সর্বভারতীয় পটভূমিতে। গুজরাতের জিগ্নেশ অথবা উত্তরপ্রদেশের চন্দ্রশেখর এখন দলিত আন্দোলনের নতুন মুখ। পাতিদার বা জাঠ আন্দোলন আর দলিত আন্দোলনের মধ্যে পার্থক্য আছে।
পাতিদার বা জাঠ ভোট এ দেশের কয়েকটি বিশেষ এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর পাতিদার বা জাঠ সম্প্রদায়ের মতো মনুষ্যগোষ্ঠী নিম্নবর্গের প্রতিনিধি নয়। তাঁদের আর্থ-সামাজিক শ্রেণি অবস্থান ভারতীয় সমাজে আলাদা। তাই যখন মূল প্রশ্নটি আসে সরকার স্যুটবুটের সরকার নাকি হতদরিদ্র গরিব আমজনতার, তখন আর্থ-সামাজিক অবস্থানটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিজেপি উচ্চবর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, এটা কিন্তু লালকৃষ্ণ আডবাণী বুঝতে পেরেছিলেন। অনেকে বলেন, আডবাণী নিজে ব্রাহ্মণ নেতা ছিলেন না। তিনি সিন্ধ্রি সম্প্রদায়ভুক্ত বৈশ্য। করাচির ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে ছিলেন। দেখুন, আডবাণী দলিত সম্প্রদায়ের বঙ্গারুলক্ষণ-কে দক্ষিণ ভারত থেকে এনে সভাপতি করেন। গুজরাতের কোনও পাতিদার নেতাকে কিন্তু সভাপতি করেননি।
দলিত শব্দটি একদা গাঁধী ব্যবহার করেন হরিজন বলে। হরিজন মানে হরির সন্তান। অর্থাৎ, ঈশ্বরের সন্তান। আবার অনেকে বলেন সিডিউল কাস্ট। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ রাজ ‘পজিটিভ ডিসক্রিমিনেশন’ বন্ধ করার জন্য সিডিউল কাস্ট শব্দটি ব্যবহার করে প্রশাসনিক ক্যাটিগরি সৃষ্টির জন্য। তবে সবচেয়ে প্রাচীন নাম হল ‘অস্পৃশ্য’। ঋক বেদ অনুসারে চতুরাশ্রম ভারতীয় ঐতিহ্য। চতুর্বর্ণ প্রথা আমরা সবাই জানি, চতুর্থ শ্রেণি শূদ্র যারা অন্য তিনটি শ্রেণির চাকর হিসেবে কাজ করবে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, শূদ্রদেরও স্পর্শ করা যেত, কিন্তু অস্পৃশ্য আর অশুদ্ধ শ্রেণি ছিল। যাদের স্থান ছিল সমাজের বাইরে, তারা অস্পৃশ্য। বর্ণব্যবস্থার মধ্যে ছিল নানা ধরনের জাতি। প্রত্যেক জাতির মধ্যে আবার ছিল সুনির্দিষ্ট বর্ণ। উত্তর ভারতের প্রধান অস্পৃশ্য জাতি ছিল চামার। গরুর চামড়া নিয়ে চর্মকারেরা কাজ করত বলে তারা অশুদ্ধ হয়ে যেত, তারা অস্পৃশ্য চর্মকার। তবে এই ধ্যানধারণা বৈদিক যুগের শেষ দিকে। প্রথম অর্ধে ব্রাহ্মণদের গোভক্ষণের কথাও লেখা আছে। মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকায় শতাধিক জাতির অস্তিত্বের কথা লেখা হয়েছে।
গুজরাতে জিগ্নেশ এখন দলিত আন্দোলনের নতুন মুখ। ফাইল চিত্র।
বি আর অম্বেডকর নিজে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেন। ভারতে ফেরেন এক জন অ্যাডভোকেট হয়ে। কিন্তু তিনি দেশে ফিরেও বুঝতে পারেন দলিতদের যদি শিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করা হয় তা হলে কোনও ভাবেই এ দেশে দলিত সমাজ মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ সরকার মুসলিমদের জন্য প্রশাসনে শতকরা ২৫ ভাগ চাকরির সুযোগ দেয়, অন্য সংখ্যালঘুদের জন্য ‘ভ্যাকেন্সি’ থাকে শতকরা ৮.৩ ভাগ। এরই মধ্যে ছিল অস্পৃশ্যরা। কিন্তু ১৯৩১ সালের আদমসুমারিতেই দলিত জনসমাজ ছিল শতকরা ১২.৫ ভাগ। দলিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও যথেষ্ট। ভারতের আদমসুমারি রিপোর্ট অনুসারে ১৯৬১ সালে দলিতের সংখ্যা ছিল ৪৩৯.২ মিলিয়ন। ২০০১ সালে তা বেড়ে হয় ১০২৮.৬ মিলিয়ন।
১৯৩৬ সালে মূলত ভূমিহীন দলিতদের নিয়ে অম্বেডকর গড়েন ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি। ১৯৪২ সালে তিনি সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন করেন। এই দলে মাহার ছিল অম্বেডকরের নিজের জাতি। কিন্তু এই সংগঠনের মধ্য দিয়ে অম্বেডকর এই সমর্থক সমাজের প্রসারণ চান। ১৯৫২ সালে তিনি দেখলেন এই সংগঠনও শুধু মহারাষ্ট্রের মধ্যেই সীমিত থাকছে। ১৯৫৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর হল রিপাবলিকান পার্টি অব ইন্ডিয়া (আরপিআই)। শুধু দলিত নয়, এই সংগঠন অন্য সমস্ত পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকেও অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে এসে বহুজন সমাজ পার্টিও এই প্রসারিত ‘বেস’-কে লক্ষ্য করে এগোয়। অম্বেডকর মারা যান তাড়াতাড়ি। কিন্তু আরপিআই-এর ভাবনাটাও ছিল তাঁর। অম্বেডকর আরও কিছু দিন থাকলে কী হত জানি না। তিনি বৌদ্ধ থেকে সমাজতন্ত্রী হন। কিন্তু এটা ঠিক, গাঁধীজির উপস্থিতিতে কংগ্রেসের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল দলিত শক্তি। ১৯৭১ সালে মহারাষ্ট্র বিধানসভার নির্বাচনে তিন জন শুধু জেতে। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অম্বেডকরের পুত্র ভাইয়া সাহেবও কিছু করে উঠতে পারেননি। ১৯৯৮ সালে লোকসভা ভোটে নাতি প্রকাশ অম্বেডকর চারটি আসন আদায় করেন। আবার বিএসপি-র কী হল দেখুন। কাঁসিরাম ছিলেন চামার পরিবারের ছেলে। পঞ্জাবে ছিল বাড়ি। সেনাবাহিনীতে দলিতরা যোগ দিতে পারবে, এই আইন হওয়ায় কাঁসিরামের বাবা ও কাকারা সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি বিএসসি পাশ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে কেমিস্টের চাকরি করেন। পুণেতে বদলি হন। সেখানে গিয়ে পঞ্জাবের দলিতদের পাশাপাশি মাহারদেরও দেখেন। তখন তিনি অম্বেডকরের আরপিআই-তে যোগ দেন। কিন্তু সেখানে প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও কংগ্রেসের সঙ্গে সখ্য দেখে ’৭১ সালে তিনি নিজে তফসিলি জাতি-উপজাতি, পিছিয়ে পড়া শ্রেণি ও সংখ্যালঘু কর্মচারীদের সংগঠন গড়েন। শুরু হয় আন্দোলন। ’৮৯ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিএসপি-র জয়ী প্রার্থী ছিলেন তিন জন আর ২০০৯ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয় ২১। শতকরা ভোট ২.০৭ থেকে হয় ৬.১৭ ভাগ।
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অ্যান্টিথিসিস হয়ে গোটা দেশে দলিত আন্দোলন মাথা চাড়া দিচ্ছে। বর্তমানে নবীন প্রজন্মও উঠে আসছে সর্বভারতীয় পটভূমিতে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ফাইল চিত্র।
এর পর আবার পতন শুরু হয় কাঁসিরামের মৃত্যুর পর মায়াবতী জমানায়। দলিত সমাজের উন্নয়ন যে সে ভাবে হল না তাতে এই দলিত-নিম্নবর্গের মোহভঙ্গ হল। এ দিকে বিজেপি সুকৌশলে উচ্চবর্ণের হিন্দুত্বের সঙ্গে অম্বেডকর পুজোও শুরু করে দিল। এ বার ২০১৭ সালে যাত্রা যখন শুরু তখন এক নতুন দৃশ্যপট। মোদীর সরকারের বিরুদ্ধে দলিত ও নিম্নবর্গের অসন্তোষ ক্রমবর্ধমান। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী অতীতের হরিজন ভোটকে পুনরুজ্জীবিত করছেন। এটা দেখা যাচ্ছে, দলিত নেতাদের সকলেরই একটা আঞ্চলিক প্রভাব ক্ষেত্র আছে। কিন্তু কংগ্রেস এক সর্বভারতীয় দল যার ছিল সাবেক দলিত ভোটব্যাঙ্ক। এ জন্য কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে এগোলে দলিত নেতাদের আঞ্চলিক বাসনা-কামনার পূর্তি হতে পারে কিন্তু ২০১৯ সালে মোদী-বিরোধিতার জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে থাকাটা যে রাজনৈতিক ভাবে সঠিক অবস্থান সেটা স্পষ্ট। আর শুধু দলিত নয়, মুসলিম নিম্নবর্ণ, এমনকী উচ্চবিত্ত কিন্তু জাঠ বা পাতিদারদের মতো জাতিগোষ্ঠীগুলিও শিক্ষার অভাবে কর্মহীনতার শিকার। এই বিবিধ অসন্তোষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে জ্বলতে এ বার এক বড় ধরনের বিদ্রোহের আগুনে পরিণত।
২০১৮-র রাজনীতি বেশ চিত্তাকর্ষক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy